পরিস্থিতি জাতীয় পার্টির জন্য ‘জটিল’ ও ‘বিপজ্জনক’ মনে করছেন নেতা-কর্মীরা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন করে চাপে পড়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। বিশেষ করে, দলীয় প্রধান জি এম কাদেরের ওপর নানামুখী চাপ দলটির নেতা-কর্মীদের শঙ্কায় ফেলেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই চাপ জাতীয় পার্টির কার্যক্রম সীমিত করে তুলেছে। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণসহ দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে। যদিও জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব বলছেন, চাপ যতই আসুক, তা মোকাবিলায় তাঁরা প্রস্তুত রয়েছেন।

গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই জাতীয় পার্টিকে এড়িয়ে চলছিল অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বৈঠক, আলোচনায় জাতীয় পার্টিকে ডাকা হয়নি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে দলীয় কর্মসূচি পালনে বাধা ও হামলার মুখে পড়েছে দলটি। সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। তার এক দিন আগে জি এম কাদের ও তাঁর স্ত্রী শরীফা কাদেরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই চাপ জাতীয় পার্টির কার্যক্রম সীমিত করে তুলেছে। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণসহ দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের
ছবি: সংগৃহীত

এর আগে জুলাই আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় জি এম কাদের, তাঁর স্ত্রীসহ অনেক নেতাকে একাধিক হত্যা মামলায় আসামি করা হয়। পরবর্তী সময়ে রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর এবং ঢাকায় পরপর দুটি ইফতার অনুষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গত ২৫ মার্চ কাজী মামুনুর রশীদ নামে রওশন এরশাদপন্থী এক নেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদ এবং মহাসচিব হিসেবে তাঁর নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেন। এসব ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করে জাতীয় পার্টি।

তবে রওশনপন্থী নেতা কাজী মামুনের তৎপরতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না জাতীয় পার্টির নেতারা। তাঁরা মনে করছেন, দলের বাইরে থাকা কিছু নেতা এর সঙ্গে যুক্ত। মূলত তাঁরা ইসিতে এ আবেদনের মধ্য দিয়ে শীর্ষ নেতাকে চাপে ফেলে দলে ফেরার কৌশল নিয়েছেন।

দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের মূল্যায়ন হচ্ছে, আপাতদৃষ্টে আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ এবং ভারতের ‘এজেন্ট’ বলে জাতীয় পার্টিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে। তবে এর লক্ষ্য হচ্ছে, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পলায়নের পর দলটির অনুপস্থিতিতে রাজনীতি ও নির্বাচনে যে শূন্যতা তৈরি করছে, সেটি যাতে কোনোভাবেই জাতীয় পার্টির দিকে না যায়, সেই পথ বন্ধ করা। কারণ, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ মাঠছাড়া হয়ে গেলেও জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে সক্রিয় এবং প্রকাশ্যে আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দলটির ভোটের একটি বড় অংশ জাতীয় পার্টির দিকে ঝুঁকতে পারে। এ রকম একটা আশঙ্কা থেকেই জাতীয় পার্টিকে নানামুখী চাপে ফেলা হচ্ছে, যাতে দল স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে না পারে।

রওশন এরশাদ
ফাইল ছবি

জাতীয় পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র-তরুণদের একটি অংশ সম্পৃক্ত। এর বাইরে প্রধান রাজনৈতিক দলের কোনো কোনোটিরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। জাতীয় পার্টির নেতাদের ধারণা, তাঁদের চাপে ফেলার লক্ষ্য, নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে নিষ্ক্রিয় ও নিস্তব্ধ করে রাখা। যাতে জাতীয় পার্টি এই সময়ের রাজনীতি ও সামনের নির্বাচনে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং এর প্রভাবে সারা দেশে দলের নেতা-কর্মীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর জন্য সরকারকে দায়ী করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু মানুষকে ওনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) দোসর হিসেবে, কিছু মানুষে ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যা দিয়ে দেশকে ভাগ করে ফেলেছেন। আমার মনে হয় এটা পঞ্চাশ ভাগের বেশি। আওয়ামী লীগ গর্তে ঢুকে গেছে, তারা যাতে কিছুতেই বের হতে না পারে। এখন জাতীয় পার্টি যদি ভোটে দাঁড়িয়ে যায় এবং যদি কিছুটাও হলে নিরপেক্ষতা থাকে, তাহলে এই লোকগুলো জাতীয় পার্টির দিকে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এটাকে তারা থ্রেট ভাবছে।’

রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে আগুন দেন কিছু ব্যক্তি
৩১ অক্টোবর, ২০২৪ ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

উদ্ভূত পরিস্থিতি ও এই সময়টাকে জাতীয় পার্টির জন্য খুবই ‘জটিল’ এবং ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করছেন দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকে। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা কতটা ঐক্যবদ্ধ থাকেন, সে প্রশ্নও রয়েছে। যদিও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে নেতা-কর্মীদের অভয় দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধান, ব্যাংক হিসাব জব্দ নিয়ে চেয়ারম্যানের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তিনি ইতিমধ্যে নেতা-কর্মীদের বার্তা দিয়েছেন, জেলে নিলে যাবেন। কিন্তু বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলবেনই। তিনি এ-ও বলেছেন, ‘নব্বইয়ের পর ছয় বছর জাতীয় পার্টি এরশাদের মুক্তি আন্দোলন করেছে। এখন জনগণের মুক্তির আন্দোলন করব।’

এখন জাতীয় পার্টির পলিটিকস একটাই, জনগণের পক্ষে কাজ করা। আমরা মাঠে কাজ করব। যেখানেই আমাদের বাধা দেবে, আমরা প্রতিহত করব।
জি এম কাদের, জাতীয় পার্টি

তবে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রকাশ্য অবস্থান শক্ত হলেও ভেতরে-ভেতরে নেতা-কর্মীরা দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। এত সহজে এ পরিস্থিতি থেকে জাতীয় পার্টি পরিত্রাণ পাচ্ছে, নেতারা সেটা মনে করতে পারছেন না। এখন পর্যন্ত সরকারের যে অবস্থান, তাতে দলের রাজনীতির ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। একইভাবে দলটির আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টিও অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কী বা দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব দল নিয়ে কী ভাবছেন, সে দিকেই অনেকের দৃষ্টি।

জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এখন জাতীয় পার্টির পলিটিকস একটাই, জনগণের পক্ষে কাজ করা। আমরা মাঠে কাজ করব। যেখানেই আমাদের বাধা দেবে, আমরা প্রতিহত করব। সবাইকে (জাতীয় পার্টির) বলেছি, এটা যদি করতে পারো, দল টিকে যাবে। বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন হতাশায় ভুগছে। এই হতাশা থেকে উদ্ধারের জন্য তারা একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম চায়। সেখানে তারা জাতীয় পার্টির দিকে তাকিয়ে আছে।’

জাতীয় পার্টির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে একটা, সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতায় নির্বাচিত সরকার আসতে হবে। কিন্তু সে নির্বাচন করার সক্ষমতা এখন পর্যন্ত এই সরকারের নেই। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে নিরপেক্ষতা দরকার, সেটিও এ সরকারের নেই। ছাত্রদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, তরুণদের নতুন দলের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সরকার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। এখন এই সরকারের অধীন নির্বাচন হলে সবাই সমান সুযোগ পাবে না, সে নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশে ভোট ব্যাংক আছে চারটি দলের—বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির। এর মধ্যে দুটি দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখলে অর্ধেক অফ হয়ে যায়। যেটা শেখ হাসিনা করেছিল। একই পদ্ধতি আবারও অনুসরণ করা হচ্ছে। এমনটা হলে নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না, দেশ স্থিতিশীল হবে না।’