১০ দিনে মাঠপর্যায়ের প্রায় আড়াই হাজার সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিকে ঢাকায় এনে মতবিনিময় করল বিএনপি। গতকাল বৃহস্পতিবার ১০ দিনের এ কর্মসূচি শেষ হয়েছে। দলটির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, কার্যত এ মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয় তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ ও জনসম্পৃক্ত নেতাদের আরও সক্রিয় করতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যে বৃহত্তর আন্দোলন গড়তে চাইছে, তাতে সাধারণ মানুষসহ সব পক্ষের ব্যাপক অংশগ্রহণ আশা করছে দলটি। সম্প্রতি ইউনিয়ন থেকে থানা, জেলা ও মহানগরে পর্যায়ক্রমে যে পদযাত্রার কর্মসূচিগুলো করা হয়, এর উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে কাছে টানা।
এ কর্মসূচির পরপরই একই লক্ষ্যে সারা দেশের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) দলীয় সমর্থক সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানদের ঢাকায় এনে মতবিনিময় করা হয়। গতকাল ময়মনসিংহ বিভাগের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে ১০ দিনের এ কর্মসূচি শেষ হয়।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর জানিয়েছে, আড়াই হাজার জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি এ মতবিনিময় কর্মসূচিতে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া যেদিন যে বিভাগের মতবিনিময় হয়, সেদিন সংশ্লিষ্ট বিভাগের দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা (রাজনৈতিক), যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, জেলা সভাপতি অথবা আহ্বায়ক, ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবেরা উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানরা নিজ নিজ এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁদের সঙ্গে গ্রামের একেবারে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক রয়েছে। তাঁরা যদি মাঠপর্যায়ের আন্দোলন-কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন, তাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর একটা প্রভাব পড়বে। এটি করা গেলে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে সাহস পাবে। এ ছাড়া সরকার পতনের লক্ষ্যে দলের ঘোষিত ১০ দফা দাবি এবং রাষ্ট্র সংস্কারের ২৭ দফার বিষয়ে মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের একটি পরিষ্কার ধারণা দেওয়াও এ মতবিনিময় আয়োজনের লক্ষ্য ছিল।
মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া ফেনী সদর উপজেলার মোটবি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করেন, আমরা যারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলাম, তারা এলাকায় একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলাম। সে কারণে সরকারের বিরুদ্ধে আমরা কীভাবে জনসাধারণকে আরও সম্পৃক্ত করতে পারি, এ ক্ষেত্রে দলের করণীয় কী—সেটা তাঁরা জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, দল যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা তা করব।’
বিএনপির সূত্র জানায়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরকারবিরোধী একটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ার লক্ষ্য নিয়ে মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে এ মতবিনিময় করেন। তিনি লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলেন। ১০ দিনের রুদ্ধদ্বার এ মতবিনিময় কর্মসূচিতে সাবেক-বর্তমান মিলে ২ হাজার ৩৬৭ জন চেয়ারম্যান অংশ নেন। এর মধ্যে ৩৫৭ জন বক্তব্য দিয়েছেন। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচিত বিএনপির সমর্থক চেয়ারম্যানদের মতবিনিময়ের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এ মতবিনিময় শুরু হয়।
ওই দিন স্বাগত বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম চেয়ারম্যানদের উদ্দেশে বলেন, ‘যেহেতু আপনারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন অথবা এখনো নির্বাচিত আছেন। সে জন্য আপনাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে এই জনগণকে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করার। সেই দায়িত্বটা আপনাদের পালন করার আহ্বান আমি জানাচ্ছি।’
দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন গড়ার লক্ষ্য নিয়ে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হলেও তা কতটা সফল হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, প্রতিটি মতবিনিময়ের আগে দলের শীর্ষ নেতারা সামনের আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল নিয়ে চেয়ারম্যানদের মতামত জানতে চেয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ চেয়ারম্যানই সুনির্দিষ্ট করে মতামত বা পরামর্শ দিতে পারেননি। বেশির ভাগের বক্তব্যে দলের স্থানীয় নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক বিষয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অনেকে থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন।
অবশ্য বিএনপির নেতারা মনে করেন, মতবিনিময় সভায় মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে অভিযোগ, ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করলেও এটিও দলের কাজে লাগবে। কারণ, এর মধ্য দিয়ে মাঠের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। এখন সাংগঠনিক দুর্বলতা বা ক্ষোভ-অসন্তোষ দূর করার সুযোগ মিলল। এ বিষয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব উদ্যোগী হলে আন্দোলন-কর্মসূচিতে এর সুফল মিলবে।
তবে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগের চেয়ারম্যানদের মতবিনিময় সভায় সবাই আন্দোলনের প্রস্তুতির কথাই বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।
১০টি মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত এ কর্মসূচিতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের একটি বার্তাই দেওয়া হয়েছে, সেটি হলো এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে।
তা না হলে দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, দেশের মানুষেরও সংকট বাড়বে। এ বার্তার সঙ্গে সবাই একমত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই রাজধানী ঢাকায় আন্দোলন কীভাবে সফল করা যায়, সে কৌশল ঠিক করতে শীর্ষ নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়েছেন।