অধিকাংশ উপজেলা চেয়ারম্যান ‘অনুগত’, সংসদ সদস্যদের স্বেচ্ছাচারিতা বাড়ার শঙ্কা
বর্তমানে উপজেলা পরিষদগুলোর বেশির ভাগ সম্পদশালী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। অধিকাংশ উপজেলায় সংসদ সদস্যদের স্বজন ও অনুগত ব্যক্তিরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর ফলে সব ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতেই কেন্দ্রীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে সংসদ সদস্যদের স্বেচ্ছাচারিতা আরও বাড়তে পারে।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই মূল্যায়ন তুলে ধরে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীদের তথ্যের বিশ্লেষণ উপস্থাপন এবং নির্বাচন মূল্যায়নে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে সংগঠনটি।
গত ৮ মে থেকে কয়েক ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সুজন নির্বাচিত মোট ৪৭০ জন উপজেলা চেয়ারম্যানের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। সুজনের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচিত ৪৭০ জনের মধ্যে ৩৬০ জনই পেশায় ব্যবসায়ী, যা শতকরা ৭৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। এরপর আছে কৃষিজীবী ৪৮ জন, আইনজীবী ১৯ জন ও ১৫ জন শিক্ষক।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী ৪৭০ চেয়ারম্যানের মধ্যে ৪২ জনের বার্ষিক আয় ১ কোটি টাকার বেশি। সুজন বলছে, নির্বাচনে স্বল্প আয়ের প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার হার কম বরং বেশি আয়ের প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার হার প্রায় দ্বিগুণ।
৪৭০ চেয়ারম্যানের মধ্যে ১১৪ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ও ১৮২ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। আর ৭৫ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল এবং বর্তমানেও আছে। নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৫৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীরা বেশি নির্বাচিত হয়েছেন। এই বিষয়কে ইতিবাচক বলছে সুজন।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে সুজনের মূল্যায়নে উঠে এসেছে। এর ব্যাখ্যায় তারা বলেছে, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রবিমুখতা এই নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বিমুখতার মূল কারণ নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা। আর এই নির্বাচনের ফলে আওয়ামী লীগের দলীয় বিভাজন ও অন্তর্দলীয় কোন্দলে সহিংসতা স্থায়ী হতে পারে। নির্বাচনে জয়ী চেয়ারম্যানদের প্রায় ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগের। সে কারণে উপজেলাগুলোতে ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়েছে।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটারদের কেন্দ্রবিমুখতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপজেলা নির্বাচন বর্জন একই সূত্রে গাঁথা। চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই ব্যবসায়ী। প্রকৃতপক্ষে ব্যবসায়ীর সংখ্যা আরও বেশি হবে। তাঁরা নির্বাচন করলে সমস্যা নেই, তবে টাকার খেলা থাকলে সমস্যা। যদি টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনেন বা ভোট কেনেন।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ভোটার উপস্থিতির এই হার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটার উপস্থিতি যা দেখানো হয়েছে, তা–ও সন্তোষজনক নয়। ৫০ শতাংশ পার হয়নি। যে হার দেখানো হয়েছে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে, প্রশ্ন আছে?
বিরোধীদের ভোটে অংশ নেওয়া উচিত
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও সুজনের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনের প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ার কৌশল কিছুটা হলেও সফল। দলীয় প্রতীক না থাকায় ভোটের হার ৩৬ শতাংশ হয়েছে। উন্মুক্ত না করে দিলে ১৬ শতাংশ হতো।
নির্বাচনে নিরপেক্ষতাসহ বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও বিরোধী দলগুলোর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলে একটা দলের প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। নির্দলীয় হিসেবে ভিন্নমতের অনেকে নির্বাচনে আসতে পারতেন।
বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাই সব কাজ করছেন এবং তাঁদের হাতেই সব ক্ষমতা বলে পর্যবেক্ষণ দেন আহসান এইচ মনসুর। তাঁর মতে, জনপ্রতিনিধিরা নখদন্তহীন, যা হওয়া উচিত নয়।
সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যানদের তথ্য বিশ্লেষণ ও নির্বাচন মূল্যায়ন নিয়ে লিখিত তথ্য উপস্থাপন করেন সুজনের প্রধান সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। তাতে বলা হয়, সংসদ সদস্যদের আত্মীয়স্বজন ও অনুগত প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতা আরও বাড়বে। বর্তমানে যে ধারায় নির্বাচন চলছে, তা নিয়মরক্ষার নির্বাচন। নির্বাচনব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নেই। এই আস্থা ফিরে না এলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।