রাজনীতি
সমঝোতার সম্ভাবনা নেই, সংঘাতের শঙ্কা
আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন পর্যন্ত মাঠ দখলে রাখার রোডম্যাপ তৈরি করেছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নিয়ে সমঝোতার কোনো উদ্যোগ এখনো নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে; বরং আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। দলটি আগামী নির্বাচন পর্যন্ত মাঠ দখলে রাখার রোডম্যাপ তৈরি করেছে বলেও জানা গেছে। এমন অবস্থানের পেছনে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির প্রতি তাঁদের অবিশ্বাসের কথা বলছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে নানা আশঙ্কা প্রকাশ করছে।
বিএনপিও সরকার পতনের তাদের আন্দোলন থেকে পিছপা না হওয়ার কথা বলছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দুই দলকে রাজপথে মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ যদি আবারও একচেটিয়া নির্বাচনের দিকে এগোয়, তাহলে রাজনীতিতে অবিশ্বাস বেড়ে যাবে এবং কমে যাবে সমঝোতার সম্ভাবনা। তখন উত্তাপ বা উত্তেজনা আরও বেড়ে যেতে পারে, এমনকি সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন।
যদিও আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচিকে বিরোধী দলের পাল্টা কর্মসূচি বলতে রাজি নয়। কিন্তু দলটির নেতারা যেসব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তাতে বিরোধী দলের কর্মসূচিই যে তাঁদের লক্ষ্য, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, তাঁদের দলে এবং সরকারে বিএনপির প্রতি অবিশ্বাস বেড়েছে। বিএনপির আন্দোলন থেকে কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে সহিংস কর্মকাণ্ড করা হতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা বলছেন তাঁরা।
সে ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় এবং তার পরের বছর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলন যে সহিংস রূপ নিয়েছিল, সেই পরিস্থিতিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলে বিএনপি অতীতের মতো আবারও সহিংস কর্মকাণ্ড করবে। সে জন্য তাঁরা রাজনৈতিক কর্মসূচি রাখছেন।
বিএনপির নেতারা আবার আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে উসকানিমূলক বলে বর্ণনা করছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা সচেতনভাবে উসকানি এড়িয়ে যাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগ বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি থেকে সরে আসবে না। দলটি আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এক বছরের জন্য কর্মসূচির একটা রোডম্যাপ তৈরি করে মাঠে নেমেছে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগও কর্মসূচি নেবে বা মাঠে থাকবে, সেখানে দোষের কিছু নেই। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটি যখন বিরোধী দলের কর্মসূচিকে লক্ষ্য করে মাঠে নামছে, তখনই প্রশ্ন উঠছে। আসলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার লম্বা সময়ে রাজনৈতিক দিক থেকে সেভাবে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি।
এখন নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখে রাজপথে থাকার চেষ্টা করছে। বিরোধী দলের এবারের মাঠে থাকার চেষ্টাকে আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বলে মনে হয়।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন আগের মতো নেই। করোনাভাইরাস মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি চলছে, দেশেও তার আঁচ কিছুটা পড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
ফলে বিএনপির দখলে মাঠ চলে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকেও ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক কর্মসূচি নিচ্ছে। একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় দেশ শাসনের পর ক্ষমতা ছাড়তে হলে আওয়ামী লীগকে কোন ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, এ বিষয়টিও দলের নেতাদের বিবেচনায় থাকতে পারে। কিন্তু পাল্টা কর্মসূচি মাঠে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, এ মুহূর্তে সেটা তাদের বিবেচনায় আসছে না।
টিকে থাকার লড়াইয়ে বিএনপি
১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এবারের নির্বাচনকে তাদের বাঁচা-মরার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বলে মনে হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। তখন একতরফা নির্বাচন করেছিল আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও সেই নির্বাচন নিয়ে তাদের নানা অভিযোগ এবং অনেক প্রশ্ন রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি এবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তাদের আন্দোলনকে একটা পরিণতিতে নেওয়ার চেষ্টার কথা বলছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ মাঠ দখলে রেখে আবারও একচেটিয়া নির্বাচনের দিকে এগোতে পারে। সে জন্য বিরোধী দল ও বিরোধী মত দমনে আরও কঠোর হতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার—এমন আলোচনাও রয়েছে বিএনপিতে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না বিএনপি—সে অবস্থান থেকে দলটির এবারের আন্দোলন ব্যর্থ হলে তাদের দলের অস্তিত্বই সংকটে পড়তে পারে। সে কারণে বিএনপি এবার শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার চেষ্টা করবে।
এখন পর্যন্ত দলটি এ অবস্থানে রয়েছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন। ফলে বিএনপি তাদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে গিয়ে লংমার্চ ও অবরোধের মতো কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়ও বিবেচনা করছে।
এবার নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি—দুই দলই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে রয়েছে। ফলে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, দুই দলই রাজপথে ততটা মরিয়া অবস্থান নিতে পারে। সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে বিএনপি তাদের আন্দোলনের গতি বাড়ানোর জন্য যদি লংমার্চ বা অবরোধের মতো কর্মসূচি নেয়, ক্ষমতাসীন দলও রাজপথে সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবে—এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। তখন বিরোধী দলের আন্দোলনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার আরও বেড়ে যেতে পারে, মাঠে রাজনৈতিক দিক থেকেও আওয়ামী লীগ আরও কঠোর হতে পারে। বিএনপির নেতাদের এমন আশঙ্কা রয়েছে।
কোন পথে রাজনীতি
বিভাগীয় শহরে সমাবেশের কর্মসূচির শেষে বিএনপি গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় যে সমাবেশ করে, সেদিন নগরীতে পাল্টা সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছিল আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে বিরোধী দলের যুগপৎ আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ পাল্টা হিসেবে সমাবেশ-মিছিল করেছে ঢাকার রাজপথে। যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিরোধী দল যাতে সন্ত্রাস করতে না পারে, সে জন্য মাঠে কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের নেতা-কর্মীরা সতর্ক পাহারায় থাকছেন।
তাঁরা তাঁদের কর্মসূচির নামও দিয়েছেন শান্তি সমাবেশ বা শান্তি মিছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতা ভিন্ন দেখা গেছে। বিএনপিকে গত ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের অনুমতি এবং জায়গার জন্য দফায় দফায় দৌড়াতে হয়েছে পুলিশের কাছে। অন্যদিকে দলটি তখন অভিযোগ তুলেছিল, তাদের সেই সমাবেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের যোগ দেওয়ার সময় নগরীর বিভিন্ন জায়গায় বাধা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
সর্বশেষ ঢাকাসহ ১০টি বড় শহরে ৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সমাবেশের দিনে আওয়ামী লীগের পাল্টা সমাবেশের কর্মসূচির কারণে রংপুর, খুলনা এবং বরিশালে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। কুষ্টিয়া থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ১২টি বাসের বহর খুলনায় সমাবেশে যাচ্ছিল। ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগের একদল নেতা-কর্মী সেই বাসের বহর থামিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বেধড়ক মারধর করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
যদিও এ ধরনের ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু পাল্টা কর্মসূচিতে উত্তেজনা বা উত্তাপ যে বাড়ছে, তা রাজনীতিকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। এখন সেই রাজনৈতিক উত্তেজনাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রামে। ইউনিয়নে ইউনিয়নে বিরোধী দলের ‘পদযাত্রার’ পাল্টা কর্মসূচি নিল আওয়ামী লীগ।
অতীতে বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দুটি পক্ষ মাঠে থাকলে অনেক ক্ষেত্রে কর্মসূচিগুলোতে অংশ নেওয়া লোকজনের ওপর নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন পরিস্থিতি গড়ায় সংঘাত-সহিংসতায়।
এখনো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, দুই দলেরই অনেক নেতা মনে করেন, যত দিন যাবে রাজপথে উত্তেজনা বাড়তে থাকবে। কোনো সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যেতে পারে।
সে ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া এবং সহনশীলতার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরই দায়িত্ব বেশি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল এ মুহূর্তে তা বিবেচনা করছে না বলেই মনে হচ্ছে।