আমাকে ‘সাইজ’ করতে মামলা করা হয়েছে: নজিবুল বশর
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী খেপেছেন সরকারের ওপর। তাঁর দুই ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করার কারণে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক) সমালোচনা করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, দুদক ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ ওই মামলা করেছে।
সুফিবাদে বিশ্বাসী তরীকত ফেডারেশন নামের একটি দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সরকার আমার কাঁধের ওপর দিয়ে স্বার্থ হাসিল করেছে। কিন্তু আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাকে “সাইজ” করতে সরকারের ভেতরে থাকা কারও ইন্ধনে এই মামলা করা হয়েছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, মামলার ‘টার্গেট’ তাঁর ছেলেরা নন, মূল টার্গেট তিনি।
সৈয়দ নজিবুল বশর তাঁর দল নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটে রয়েছেন। এই জোটে থেকেও তিনি সরকারের সমালোচনায় নেমেছেন। সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘দুদকের মামলার বিষয়ে সরকারের কেউ জানে না—এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ১৪ দলের সঙ্গে থাকব, তার মানে অন্যায় সহ্য করব, এটাও না।’
তরীকত ফেডারেশনের এই নেতা কয়েক দিন ধরে সরকারের সমালোচনা যে করছেন, এ অবস্থানের ব্যাপারে আজ বৃহস্পতিবার তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপেও সরকারের সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর এই সমালোচনার কারণে ১৪–দলীয় জোটে তাঁর দলের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে তিনি মন্তব্য করেন, ‘১৪ দলের সঙ্গে থাকব, তার মানে অন্যায় সহ্য করব, এটাও না।’
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ তাদের শরিক তরীকত ফেডারেশনের নেতার বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর ছেলের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করার কারণেই তিনি নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন বলে তাঁরা মনে করেন।
তবে দুদকের মামলাটিকে রাজনৈতিক মামলা উল্লেখ করে সৈয়দ নজিবুল বশর বলেন, ‘সরকারের উচ্চ মহল এই মামলার বিষয়ে জানে না। এই মামলায় সবাই অবাক। কোনো ইন্ধন না থাকলে এই মামলা হওয়ারই কথা নয়। মামলার টার্গেট আমার ছেলেরা নয়, মূল টার্গেট আমি। সরকারের উচিত কারা এর পেছনে ইন্ধন দিয়েছে, সেটা খুঁজে বের করা।’
‘আমি মামলা না করলে নিজামী-মুজাহিদদের ফাঁসি হতো না’
সরকার তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে স্বার্থ হাসিল করেছে (বেনিফিশিয়ারি) দাবি করে তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে নিজামী-মুজাহিদদের বিরুদ্ধে মামলা করি। তাঁদের জেলে ঢোকাই। তারপর তাঁদের যুদ্ধাপরাধীদের মামলায় নিয়ে গেছেন। যদি আমি না থাকতাম, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হতো না। তাঁদের ফাঁসিও হতো না। এটা বাস্তব সত্য। কখনো তো সরকারের কাছে কিছু চাইনি।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার কথা জানিয়ে নজিবুল বশর বলেন, ‘সংসদে দাঁড়িয়েও বলেছি, আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন, এই এলাকা থেকে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হব। দুদকের মামলার বিষয়ে সরকারের কেউ জানে না—এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’
দুদকের মামলাকে সুফি মতবাদের ওপর আঘাত উল্লেখ করে নজিবুল বশর বলেন, ‘বাংলাদেশে মাইজভান্ডার দরবার শরিফ মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল। আজও আছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সব সময় ছিলাম। আত্মাসাৎ শব্দটি সুফিবাদের অনুসারী লোকজনের জন্য অসম্মানজনক। বাধ্য হয়ে এসব কথা বলতে হচ্ছে।’
সৈয়দ নজিবুল বশর বলেন, ‘কথা নাই, বার্তা নাই দুদক মামলা করল। যেভাবে আত্মসাৎ শব্দটি এসেছে, তা খুবই অসম্মানজনক। ৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ৬৫ কোটি টাকা ফেরত দিলে আত্মসাৎ কীভাবে হয়। ট্যাক্স ফাইলেও ওই টাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। সবকিছু দৃশ্যমান থাকার পরে সেটা কীভাবে আত্মসাৎ হয়।’
মামলার অভিযোগ নিয়ে যা বললেন তিনি
প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগে নজিবুল বশরের দুই ছেলেসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তাঁর এ দুই ছেলে হলেন তরীকত ফেডারেশনের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ তৈয়বুল বশর মাইজভান্ডারী ও সৈয়দ আফতাবুল বশর।
সৈয়দ নজিবুল বশর বলেন, ‘ব্যাংক বলতে পারে সুদের কিছু টাকা বাকি আছে। করোনা মহামারির কারণে একটু সমস্যা হয়ে গেছে। ব্যাংক চাইলে তারা সেটা মওকুফও করতে পারত। যেভাবে আত্মসাৎ শব্দটি এসেছে, সবাই ধরে নিয়েছে, এটাই হয়েছে। আমরা তো রাস্তার লোক না। আত্মসাৎ বলে মিডিয়ায় দিয়ে দিল।’
নজিবুল বশর দাবি করেন, ‘আমি অন্য ৮-১০ জন সংসদ সদস্যের মতো না। আমি একটি সুফি মতবাদের পক্ষের। মাইজভান্ডার দরবার শরিফ এটা আধ্যাত্মিক জগতের প্রাণকেন্দ্র। মাইজভান্ডারকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে।’
দুদকের সমালোচনা করে নজিবুল বশর বলেন, হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, দুদক কী করে? এর আগে হুট করে ১১৬ জন আলেমের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল দুদক। মামলা করার আগে দুদকের আরও ভালোমতো বিষয়গুলো জেনে নেওয়া উচিত ছিল। দুদক প্রমাণ করুক টাকা পাচার হয়েছে।
এর আগে দুদক যখন মামলার করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই পটভূমিতেই গত সোমবার রাতে মাইজভান্ডারী শাহি ময়দানে সৈয়দ শফিউল বশর মাইজভান্ডারীর ১০৪তম খোশরোজ শরিফ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় দুদককে হুঁশিয়ারি দেন নজিবুল বশর। তিনি বলেন, ‘দুদক নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে চেনে নাই। যা–তা কমেন্ট করছেন সহকারী পরিচালক। চামড়া সব ছিঁড়ে ফেলব। মাইজভান্ডারীর গায়ে হাত!’
আজ দুপুরে নজিবুল বশর প্রথম আলোকে বলেন, চামড়া সব ছিঁড়ে ফেলব—এ বক্তব্য তিনি রাগের মাথায় বলে ফেলেছেন। এটি তাঁর বলা ঠিক হয়নি বলেই তিনি উল্লেখ করেছেন।
নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে সাংসদ হয়েছিলেন। দল বদল করে তিনি ২০০১ সালে বিএনপির টিকিটে নির্বাচনে হেরে যান। পরে বিএনপি ছেড়ে তিনি আবার গঠন করেন তরীকত ফেডারেশন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক তরীকত ফেডারেশন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য হন আওয়ামী লীগের জোট থেকে।