৩২ নম্বরে যেতে যত বাধা
গন্তব্যস্থল জানাতেই রিকশাচালক বললেন, ‘৩২ নম্বরে যাওয়া যাইবে না। খুব গ্যাঞ্জাম। আগে নাইম্যা যায়েন।’ আজ বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের উল্টো দিক থেকে রিকশায় চড়লাম। রিকশাচালকের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে।
রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা। এর মধ্যে চলছে কিছু রিকশা ও যানবাহন। পান্থপথ মোড় পার হতেই রাস্তার উল্টো দিক থেকে বিএনপির একটি মিছিল আসছিল। সেখানে আওয়ামী লীগবিরোধী স্লোগান। শ পাঁচেক তরুণ আছেন মিছিলটিতে। অনেকেরই হাতে লাঠি ও সবুজ রঙের প্লাস্টিকের পাইপ। সেগুলোর কোনো কোনোটির মাথায় জাতীয় পতাকা।
রাস্তার দুই পাশে অনেক স্থানে লাঠি নিয়ে তিন থেকে চারজনের ছোট ছোট দল বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। ৩২ নম্বরের আগে যেতেই কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী থামালেন। সেটা স্কয়ার হাসপাতালের উল্টো দিকে। তাঁদের প্রত্যেকের কথা, ৩২ নম্বরে যাবেন না। গণমাধ্যমকর্মীদেরও সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। গণমাধ্যমকর্মীদের পাশে ছিলেন এক ছাত্রদল কর্মী। তিনি বললেন, ‘গতকাল সারা রাত আমরা ৩২ নম্বরে ছিলাম। আমাদের সেখানে থাকতে বলা হয়েছিল। পরে ভোরের দিকে চলে আসি। এরপর জায়গাটা চলে যায় জামায়াত-শিবিরের হাতে। সংবাদপত্রের লোকদের ওপর আমাদের কেউ হামলা করেনি।’
এ কথা বলে ছাত্রদলের ওই নেতা তাঁর পরিচিত জামায়াতের এক নেতাকে ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, গণমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে এমন আচরণ কেন করা হচ্ছে। জামায়াতের নেতার সঙ্গে ছাত্রদল নেতার কথোপকথনের সারমর্ম এই, ‘কিছু ছেলে আছে। গণমাধ্যমকর্মীর আড়ালে কেউ যেন ঢুকতে না পারে, সে জন্যই তারা তৎপরতা দেখাচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে একটি টেলিভিশনের কর্মী তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘গাড়িটা (মাইক্রোবাস) কোনোক্রমে রক্ষা পেয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী পেলেই তাঁর ওপর চড়াও হচ্ছে। সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই। একজন কালো কাপড় পরে আসছিল। প্রচণ্ড মারধর করা হলো।’
৩২ নম্বরের কাছে থেকে ফিরে আসা একটি জাতীয় দৈনিকের মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরি করেন এমন একজন তাঁর অভিজ্ঞতা জানালেন। তিনি বলছিলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিলে লাঞ্ছনা জুটছেই। আন্দোলনকারী পরিচিত দু-একজনকে সঙ্গে করে ৩২ নম্বরের দিকে যাচ্ছিলাম। ঘাড়ে পত্রিকার আইডি কার্ডটি ঝোলানো। বাধাদানকারীরা বললেন, দাঁড়ান আগে দেখে নিই পত্রিকা কী ছাপাইছে। এরপর পত্রিকার অনলাইন দেখে বলল, যান মাফ পেয়ে গেলেন। বিপক্ষে কিছু লেখেন নাই।’
আজ সকাল সাতটার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী ৩২ নম্বরের গিয়েছিলেন। নিগৃহীত হতে হয়েছে তাঁকেও।
আজ বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) সকাল সাতটার দিকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
কাদের সিদ্দিকী পরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সকাল সাতটার দিকে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দিতে পারিনি। খুবই ভালো লেগেছে যে দু-একজন সালাম দিয়ে বলেছে আপনি ফিরে যান। আমি গাড়ির ভেতরে ছিলাম। কয়েকজন ঢিল ছুড়েছে। লাঠি দিয়ে গাড়ি ভেঙেছে। তারপর আমি চলে এসেছি।’
এরপর যিনি বা যাঁরাই গেছেন, তাঁদের কেউই ঢুকতে পারেননি। যাঁকে পাওয়া গেছে, ধাওয়া দিয়েছে বা প্রচণ্ড মারধর করেছে। পুরো এলাকার একই চিত্র।
আজ ৩২ নম্বরের আশপাশে সকাল থেকে ছিলেন প্রথম আলোর এক রিপোর্টার ও ফটোসাংবাদিক। রিপোর্টার তাঁর অভিজ্ঞতা বলছিলেন, ‘গলায় কার্ড ঝুলিয়ে ৩২ নম্বরের দিকে যেতে চাইলে ঘিরে ধরল কয়েকজন। পত্রিকার নাম বলাতে একজন আমাকে সামনের দিকে যেতে দিলেও কয়েকজন জোর শব্দে বাধা দিয়ে উঠল। এরপর বাধার মুখে আর যেতে পারিনি।’
স্কয়ার হাসপাতাল থেকে সামনের দিকে না এগোনোর জন্য গণমাধ্যমকর্মী এবং সেখানে থাকা ছাত্রদলের একাধিক নেতা অনুরোধ করলেন। খানিক বাদে স্কয়ার থেকে একা একা সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। রাস্তার ডান দিক ধরে খানিকটা যাওয়ার পর ছয়জনের একটি দল ঘিরে ধরল। পরিচয় জানালাম। বললেন, ‘চইল্যা যান। সব জায়গায় ভালো ব্যবহার পাবেন না।’