নতুন দুই দলে মনোনয়নের ‘দরজা’ সবার জন্য খোলা
নতুন নিবন্ধিত দুই রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে চায়। তবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। দুই দলই বলছে, বিএনপিসহ অন্য দলের যে কারও জন্য তাদের মনোনয়নের ‘দরজা’ খোলা। কারও ‘ইন্ধনে’ না, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল রাখতেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার দাবি দল দুটির শীর্ষ নেতৃত্বের।
রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে কিছু ‘কিংস পার্টি’ গঠন করে বিরোধী দলগুলোতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে সরকার। এই আলোচনায় অপেক্ষাকৃত নতুন নিবন্ধিত তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের নাম বেশি এসেছে।
এ দলগুলোতে বিএনপির দলছুট বা অন্য দলের নেতারা ভিড়বেন এবং তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন—এমন একটা পরিকল্পনার পেছনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ রয়েছে বলে অভিযোগ করছে বিভিন্ন দল। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু এখনো গুছিয়ে ওঠেনি। ফলে এই দলগুলোর নির্বাচনী কার্যক্রমে কিছুটা অগোছালোভাব রয়েছে।
আমরা প্রকাশ্যে ইনভাইট (আমন্ত্রণ) করছি, যারা নির্বাচন করতে চায়, তারা আমাদের মনোনয়নপত্র তুলুক। আমাদের দরজা সবার জন্য খোলা। যেকোনো ব্যক্তি আমাদের মার্কা (সোনালি আঁশ) নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে। ৩০০ আসনেই আমরা প্রার্থী দেবতৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার
তবে গতকাল সোমবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগ দিয়েছেন বিএনপির সাবেক চারজন সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্যদের বিএনএমে যোগদানের ঘোষণা দেওয়া হয়।
শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ছাড়া নতুন দলটিতে নাম লেখানো অপর তিন নেতা হলেন ঝিনাইদহ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল ওহাব, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান শামসুল আবেদিন এবং বরগুনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুর রহমান। তাঁরা সংবাদ সম্মেলন মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও বক্তব্য দেননি। তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন বিএনএমের মহাসচিব মো. শাহ্জাহান।
১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ভোট গ্রহণ করা হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর।
হাফিজ উদ্দিন আহমদ সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। সাকিব আল হাসানের বিষয়ে যে আলোচনা তা গুঞ্জন নাকি সত্যি, কিছুদিনের মধ্য সাকিব নিজেই পরিষ্কার করবেন।বিএনএমের মহাসচিব মো. শাহ্জাহান
৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে তৃণমূল বিএনপি
তৃণমূল বিএনপি ১৮ নভেম্বর শনিবার থেকে দলের মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করেছে। গত রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৮৪টি মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছে দলটি। তৃণমূল বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়ে গত রোববার দুপুরে দলের মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকারের সঙ্গে কথা হয় তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে।
তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রকাশ্যে ইনভাইট (আমন্ত্রণ) করছি, যারা নির্বাচন করতে চায়, তারা আমাদের মনোনয়নপত্র তুলুক। আমাদের দরজা সবার জন্য খোলা। যেকোনো ব্যক্তি আমাদের মার্কা (সোনালি আঁশ) নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে। ৩০০ আসনেই আমরা প্রার্থী দেব।’
তৃণমূল বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁরা প্রকাশ্যে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। বিএনপিকে ভাঙার উদ্দেশ্যে তাঁরা মাঠে নামেননি। এ বিষয়ে তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘বিএনপি আমাদের টার্গেট না। তবে বিএনপিসহ যেকোনো দলের ব্যক্তি আমাদের দলে আসতে পারেন। সরকারকে তোষামোদ করে ও একবিন্দু ছাড় দিয়েও কিছু বলা হয়নি। আমরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ চাই।’
তৃণমূল বিএনপির মনোনয়নপত্র তুলেছেন বিএনপি নেতা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর ছেলে চৌধুরী ইরাদ আহমেদ সিদ্দিকী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলোচিত সংসদ সদস্য প্রয়াত উকিল আবদুস সাত্তারের ছেলে মাইনুল হাসান। তৃণমূল বিএনপির মনোনয়নপত্র মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বিক্রি করা হবে।
‘প্রগতিশীল ইসলামী জোট’ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি গত শনিবার নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়ে জানিয়েছে তৃণমূল বিএনপি। এই জোটে থাকা ১৫টি রাজনৈতিক দলের কারও নিবন্ধন নেই। তবে এর মধ্যে কয়েকটি দল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। মনোনয়নপত্র বিক্রি শেষে জোটবদ্ধ শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে আলোচনায় বসবে তৃণমূল বিএনপি।
তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন সমশের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনের জন্য মনোনয়নপত্র তুলেছেন। মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার এখনো কোন আসন থেকে লড়বেন, তা মনস্থির করেননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আমার সাংগঠনিক ভিত্তি ভালো। বিএনপি থেকে দুইবার রূপগঞ্জে মনোনয়ন পেয়েছিলাম। সদরের সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচন করেছি। দলের মহাসচিব হিসেবে দুই আসনেও প্রার্থী হতে পারি।’ তবে দলের চেয়ারপারসন বা মহাসচিব ঢাকার কোনো আসন থেকে প্রার্থী হতে চাচ্ছেন না।
তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজমুল হুদা। তিনি ১৯৯১ ও ২০০১ সালে দুই দফায় খালেদা জিয়ার সরকারে মন্ত্রী ছিলেন। গত ১৯ সেপ্টেম্বর দলের প্রথম সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। দলের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদাকে দলটির নির্বাহী চেয়ারপারসন নির্বাচিত করা হয়। অন্তরা হুদা রোববার পর্যন্ত কোনো আসন থেকে দলের মনোনয়নপত্র তোলেননি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ তৃণমূল বিএনপির
গত রোববার রাতে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকারসহ তিনজনের একটি প্রতিনিধিদল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা গণভবনে প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করেন। তৃণমূল বিএনপির নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে আলোচনা হয়।
এই বিষয়ে তৈমুর আলম খন্দকার গতকাল সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ডেকেছিল তাই গিয়েছিলাম। আমরা বলেছি, সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হবে। ২০১৪ ও ২০১৮–এর মতো কোনো নির্বাচন হবে না। আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে বলেছি।’
‘শুধু বিএনপি না, বিভিন্ন দল থেকেই লোকজন যোগাযোগ করছেন’
আরেক নতুন নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও (বিএনএম) নির্বাচনমুখী তৎপরতা শুরু করেছে। নির্বাচনের জন্য বিএনএমের পার্লামেন্টারি বোর্ড গত রোববার সন্ধ্যায় গঠন করার কথা জানিয়েছেন দলের নেতারা। আজ মঙ্গলবার থেকে দলের মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করা হবে। এরপর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। রাজনীতিতে প্রভাবশালী ও সমাজের ‘পরিচিত মুখ’ অনেকেই মনোনয়নপত্র নেবেন বলে বিএনএমের নেতারা দাবি করছেন। দলটি ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে চায়।
সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বিএনএমে যোগ দিতে পারেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। এ বিষয়ে দলের মহাসচিব মো. শাহ্জাহান বলেন, ‘হাফিজ উদ্দিন আহমদ সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। সাকিব আল হাসানের বিষয়ে যে আলোচনা তা গুঞ্জন নাকি সত্যি, কিছুদিনের মধ্য সাকিব নিজেই পরিষ্কার করবেন।’
কারও ইন্ধনে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না দাবি করে বিএনএমের মহাসচিব বলেন, পটপরিবর্তনের আগে আগে নিবন্ধন পেলেও তিন-চার বছর আগে থেকেই মাঠে নেমেছি। শুধু বিএনপি না, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেই লোকজন যোগাযোগ করছেন। যোগ্য হলে তাঁদের দলের প্রতীক ‘নোঙর’ নিয়ে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে।
নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নিবন্ধিত বিএনএমেও দ্বন্দ্বের আভাস মিলছে। গত ১০ আগস্ট বিএনএম ইসির নিবন্ধন পায়। তখন দলের আহ্বায়ক ছিলেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুর রহমান এবং সদস্যসচিব ছিলেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য মেজর (অব.) মো. হানিফ।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে এক নেতার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে বিএনএমের কাউন্সিলে আগের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ও জাতীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কাউন্সিলে ১০০টি পদ পূরণ করা হয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদসহ অন্যান্য পদ খালি রাখা হয়। গতকাল সোমবার বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে বিএনএমে যোগ দেওয়ার পর তাঁকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে দলটির বিলুপ্ত কমিটির নেতারা কোনো এক নেতার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে কাউন্সিল করা ও নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। দলটির আগের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোপন জায়গায় কয়েকজন মিলে বৈঠক করে সেটাকে দলের কাউন্সিল বলছেন। কে বা কার আদেশে তাঁরা এটা করছেন, জানি না।’
বিএনএমের নতুন কমিটির মহাসচিব শাহ্জাহান বলেন, ‘সরোয়ার হোসেন কেন এভাবে বলছেন, তা বলতে পারব না। তাঁকেসহ আহ্বায়ক কমিটির সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এই সময়ে এসে এসব কথা না বলাই ভালো।’ নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দিলেও যাঁরা বিএনএমের নতুন কমিটি গঠনের দাবি করেছেন, তাঁরা পুরোদমে নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন।