জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে ১৬ বছরের ত্যাগের অন্তর্ভুক্তি চাইবে বিএনপি

জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরির যে দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছে, সেটাকে সমর্থন করে সব রাজনৈতিক দল। কিন্তু সরকারের এ উদ্যোগ কতটা সফল হবে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় আছে।

তবে রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের পক্ষ থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া নিয়ে হঠাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেমেছে। এ নিয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক-বিভেদও আপাত এড়ানো গেছে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, গণ-অভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ কীভাবে তৈরি হবে, এই ‘ঘোষণাপত্রে’ কী কী থাকবে?

ইতিমধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির ছাত্রনেতারা ঘোষণাপত্রে বাহাত্তরের সংবিধানকে বাতিল করা, আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা এ ঘোষণায় কেবল জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনের গণ-অভ্যুত্থানের সময় নয়, বিগত ১৬ বছরের আন্দোলনের, ত্যাগের স্বীকৃতি চাইবেন। তবে সরকারের উদ্যোগকে সঠিক বলে মনে করছেন বিএনপির নেতৃত্ব।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করেন, এ ঘোষণায় বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, গুম-খুন, নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুমসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা—সব থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে একমত হয়ে তা করতে হবে।

যদিও ছাত্রদের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে ভিন্নমত আছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির। তারা এটাকে ‘বিপ্লব’ নয়, ‘গণ-অভ্যুত্থান’ মনে করে। ফলে ‘প্রোক্লেমেশন’ নয়, গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে একটা ‘ডিক্লারেশন’ বা ‘ঘোষণা’ আসতে পারে বলে মনে করে দলটি।

‘প্রোক্লেমেশন’ বা ঘোষণাপত্রে সংবিধান স্থগিত করার কথা থাকে। তখন সামরিক ফরমান বা প্রোক্লেমেশন দিয়ে সংবিধানকে স্থগিত করা হয়। এই ঘোষণাপত্রের অধীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা রাষ্ট্রপতি সংবিধানের যেকোনো ধারা বা ধারার অংশবিশেষ সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন–বিয়োজন করতে পারেন। তখন সংবিধান কার্যকর থাকে না। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার প্রশ্নগুলোও আর থাকে না।

আরও পড়ুন

বিএনপি মনে করে, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। সে অভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার হয়েছে। এই সরকার সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়েছে। সরকার গঠনের প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় এসে ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার সুযোগ নেই।

বিষয়টি নিয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গত সোমবার দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁরা ছাত্রদের এ উদ্যোগকে ‘স্বাধীন মতপ্রকাশের’ জায়গা থেকে স্বাগত জানান।

অবশ্য ছাত্রদের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করা নিয়ে রাজনীতির ভেতরে-বাইরের হস্তক্ষেপে এ-সংক্রান্ত পটভূমি ইতিমধ্যে বদলে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরির কথা জানিয়েছে। ছাত্ররা ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি পালন করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের নেতারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার যে ঘোষণাপত্র দেবে, তা অফিশিয়ালি বলেনি। ছাত্রদের কথাও পরিষ্কার নয়। এ অবস্থায় কোনো মন্তব্য করা সমীচীন মনে করছি না।’

আরও পড়ুন

গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের চেয়ে এ মুহূর্তে জনজীবনের সংকট ও নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হওয়াকেই প্রাধান্য দিতে চান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত পাঁচ মাসে সরকার যে ধরনের উদ্যোগ নেয়নি, এখন নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে কিছু করতে পারবে, তা আমার বোধগম্য হয় না। এর বাস্তব প্রয়োগও দেখি না। বরং সরকারের উচিত হবে, আর কালক্ষেপণ না করে নতুন বছরের শুরুতেই সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা করে নির্বাচনের রোডম্যাপে যাওয়া।’

গত রোববার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জানায়, তারা ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেবে। এতে রাজনৈতিক দলের নেতা ও সরকারের উপদেষ্টারাও থাকবেন।

ছাত্রদের এই উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া হয়। শেষ মুহূর্তে এসে জরুরি প্রেস ব্রিফিং করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্র গৃহীত হবে। শেষে ছাত্ররা শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।

বিলম্বে হলেও সরকারের এ উদ্যোগকে ‘ইতিবাচক’ মনে করেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এখন পর্যন্ত তিনটি বৈঠক হয়েছে। সেগুলো ছিল কার্যত সরকারের প্রয়োজনে। এর বাইরে রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনকারী শক্তিগুলোর মধ্যে যে ঐক্য দরকার, সে বিষয়ে সরকারের দিক থেকে কোনো পদক্ষেপ ছিল না। ছাত্ররা যখন ঘোষণাপত্র নিয়ে একটা চরম অবস্থায় চলে গেলেন, তখন সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ভালো উদ্যোগ।

আরও পড়ুন

একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্ররা বলেছিল, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র সংবিধানের অংশ হবে। তার জন্য তো ঐকমত্য লাগবে। নইলে ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ছাত্ররা নিজেরা ঘোষণাপত্র দিয়ে দিলে বিতর্কের সৃষ্টি হতো। সরকার হয়তো বাস্তবতা বুঝেছে। এটাই মনে হয় ভালো হবে। আমরা বিতর্ক থেকে রক্ষা পাব।’

‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন’-এর বিষয়ে নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, এটি হবে গণ-অভ্যুত্থানের একটি দালিলিক প্রমাণ। কোটা আন্দোলন থেকে কীভাবে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, কেন মানুষ জীবন দিয়েছে—সবকিছু উঠে আসবে।

তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে যা-ই থাকুক, এটি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল বা ‘কবর’ রচনার প্রশ্নে ইতিমধ্যে অনেকে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন সিপিবির একজন দায়িত্বশীল নেতা। তিনি ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতার বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রদের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিয়েছে। কিন্তু এখন সেটা নিজস্ব গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধকেও বিতর্কিত করছে, যা নতুন নতুন প্রশ্নের উদ্রেক করছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরি এবং এর প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রায় সব দলই মনে করে, চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল অভূতপূর্ব ঐক্যের ফল। এই গণ-অভ্যুত্থানের একটি দালিলিক প্রমাণ থাকা উচিত। ফলে বিষয়টিকে রাজনৈতিক দলগুলোর হালকাভাবে দেখা উচিত হবে না।

আরও পড়ুন

কেউ কেউ কেউ মনে করছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কৃতিত্ব ছাত্রদের হাতে চলে যাবে। তাঁরা রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন। এ আশঙ্কায় কোনো কোনো দল ছাত্রদের প্রতিপক্ষ ভাবা শুরু করেছে।

তবে চব্বিশের অভূতপূর্ব বিপ্লব নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকীর্ণতায় ভোগা উচিত হবে না বলে মনে করেন ইসলামী আন্দোলনের নেতা গাজী আতাউর রহমান।

এ প্রসঙ্গে এবি পার্টির একজন নেতা উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘যেমন ধরুন, বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এর কী বিচার হবে? হলে কারা আসামি হবেন, ছাত্ররা? বিএনপি-জামায়াত বা অন্য কেউ? এ ধরনের জায়গায় রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এবং একটা ঘোষণায় যাওয়া উচিত যে এ ঘটনায় মামলা হবে না, এর বিচার হবে না। এটা বিপ্লবের অংশ।’

‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ থাকা দরকার মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেটা সব অংশীজনের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হওয়াই উচিত।’