‘ভোটের অধিকার’ আদায়ে আ.লীগের পথেই হাঁটবে নুরুলদের দল
‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল এনেছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক ও তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা। জাতীয় রাজনীতিতে যাত্রার শুরুতে তাঁরা পাশে পেয়েছেন রেজা কিবরিয়াকে। দলটির আহ্বায়ক হয়েছেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে অক্সফোর্ড থেকে পড়ে আসা রেজা কিবরিয়া।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের জামান টাওয়ারে ছাত্র, যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই দলের ঘোষণা দেওয়া হয়। দলটির ৮৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণাও করা হয়। এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন নতুন এই দলের নেতৃত্বে থাকা রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক।
দলের সদস্যসচিবের দায়িত্ব নেওয়া নুরুল হকের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, তাঁদের নতুনত্ব কী। জবাবে নুরুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে বড় দুটি দলের রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক। কারও বাবার পরে মেয়ে, কারও স্বামীর পরে স্ত্রী। আমাদের দল কখনো রেজা কিবরিয়া ও নুরুলের দল হবে না। এখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরবর্তী নেতৃত্ব ঠিক হবে। আমরা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের কথা বলছি।’
গণতান্ত্রিক এই লড়াইয়ে জনগণের ‘ভোটের অধিকার’ পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে বড় করে দেখছেন গণ অধিকার পরিষদের নেতারা। এই লড়াইয়ের কর্মকৌশল কেমন হবে, তা নিয়েও কথা বলেছেন তাঁরা।
মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে এখন যে প্রধানমন্ত্রী আছেন, ওনার শিক্ষা নেব। উনি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৯১ সালে কাজ করেছেন, আমরা সেভাবে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করছি। যাঁরা বাংলাদেশের জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করতে রাজি আছেন, আমরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলব, তাঁদের সঙ্গে কাজ করব। এ ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকলে থাকতে পারে, তাতে আমাদের কিচ্ছু করার নেই।’
দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিল রাজনৈতিক দলগুলো। সে সময় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ যেমন আন্দোলন করে, তেমনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীও রাজপথে ছিল।
নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে গণ অধিকার পরিষদ মাঠে নামবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নিয়ে আন্দোলন করাকে আমি এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। আসল কথা হলো, আমরা একটা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই। জাতিসংঘের পরিচালিত একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা চাই। এটা ছাড়া নির্বাচনে নামার কোনো মানে হয় না। যারা আগে প্রতারণা করেছে দুবার (২০১৪ ও ২০১৮ সালে), তারা তৃতীয়বার যে প্রতারণা করবে না, আমি এটা ভরসা করি না। সুতরাং আমরা প্রতারকদের নির্বাচনে যাব না, এটা পরিষ্কার।’
গণ অধিকার পরিষদ নির্বাচনে কারও সঙ্গে জোটবদ্ধ হবে কি না, জানতে চাইলে রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘জোটবদ্ধ নিশ্চয়ই হব। তবে কার সঙ্গে জোট হবে, সেটা তখনকার পরিস্থিতির আলোকে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যোগ দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন রেজা কিবরিয়া। কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোও। জোটের প্রার্থী হিসেবে রেজা কিবরিয়াও পৈতৃক এলাকা হবিগঞ্জের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ওই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল বিএনপির, মাত্র সাতটি আসনে জিতেছিলেন তাদের প্রার্থীরা।
এই নির্বাচনের পর গণফোরামের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে এসেছিলেন রেজা কিবরিয়া। এ নিয়ে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে গণফোরাম ছাড়ার ঘোষণা দেন রেজা কিবরিয়া। এখন তাঁকে নতুন দলে দেখে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা।
আপনি কিছুদিন গণফোরামের ছিলেন, এখন গণ অধিকার পরিষদে, আগামী দিনে নতুন কোনো দলে প্রস্তাব পেলে যাবেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘এটা হলো গণমুখী একটা দল। আমি মনে করি, এখানে থাকাই সবচেয়ে শ্রেয়।’
নতুন দলের প্রথম কর্মসূচি কী হবে, এ প্রশ্নের জবাবে রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘এখানকার বড় ইস্যু হলো সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাটা বেশি মাথা তুলেছে অনেক বছর পর। আমরা মনে করি, যেগুলো ঘটেছে, এগুলো সাজানো নাটক। এ দেশের কিছু লোক এবং বাইরের কিছু লোকের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এই অসহায় মানুষদের অত্যাচার করা হয়েছে। আমরা এটার বিরুদ্ধে একটা শক্ত অবস্থান নেব।’
আগামী নির্বাচন নিয়ে গণ অধিকার পরিষদের পরিকল্পনা জানতে চাইলে রেজা কিবরিয়া বলেন, পরিকল্পনা এই মুহূর্তে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়া। কিন্তু পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে বিষয়টা। তবে প্রথম কাজ হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা।
নিরপেক্ষ সরকার ফেরাতে না পারলে কী করবেন, প্রশ্নের জবাবে গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক বলেন, ‘জনগণ সঙ্গে থাকলে আমরা নিশ্চয়ই আদায় করতে পারব। জনগণ আমাদের বড় শক্তি, এই শক্তির ওপর ভরসা করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছি।’
দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে নুরুল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায় যেন বাংলাদেশকে গড়তে পারি, সেই লক্ষ্য নিয়ে তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন ধারার রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। আমাদের দলের নাম ঠিক করা হয়েছে গণ অধিকার পরিষদ। আমাদের স্লোগান হবে, “জনতার অধিকার, আমাদের অঙ্গীকার”।’
নতুন দলের নাম ঘোষণার জন্য বড় মিলনায়তন না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নুরুল হক। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারিনি। আজকে এমন একটা শাসনকাল অতিক্রম করছি, যখন মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকারগুলো বলতে গেলে হারিয়ে গেছে। যে কারণে আজ সভা-সমাবেশ করার অধিকারও নেই। আজকের অনুষ্ঠান করার জন্য আমরা আবেদন করেও বড় মিলনায়তন পাইনি। আমরা এর নিন্দা জানাই।’
সংবাদ সম্মেলনে নুরুল হক গণ অধিকার পরিষদের ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান। এরপর দলের চার দফা মূলনীতি (গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ) ও ২১ দফা কর্মসূচি পড়েন যুগ্ম আহ্বায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খান। সবশেষে আহ্বায়ক কমিটির নাম ঘোষণা করেন দলের নবনিযুক্ত আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া।
আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে যোগ দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি নতুন দলের সংগঠকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমি এসেছি একটা বিশ্বাস নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে। রেজা কিবরিয়া অক্সফোর্ডে পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিত। আর নুরুলরা স্বপ্ন দেখাতে জানে এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে। এই তরুণদের সংগ্রামের ঐতিহ্য আছে। তোমরা সততার প্রতীক, তোমরাই নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারো। নতুন উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই।’