কারণ দর্শানোর নোটিশের পর গাজীপুরে ‘উপেক্ষিত’ মেয়র জাহাঙ্গীর
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল গত ২১ অক্টোবর। এ উপলক্ষে গাজীপুরের মূল ক্যাম্পাসে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি। প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসানও ছিলেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। মোজাম্মেল হক ও জাহিদ আহসান দুজনই গাজীপুরের দুটি আসনের সাংসদ।
এ অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি আমন্ত্রণপত্রে নাম ছিল না গাজীপুরের সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের। এমনটা নিকট অতীতে ঘটেছে, তা মনে করতে পারেন না এ বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
মেয়র জাহাঙ্গীরকে গাজীপুরের স্থানীয় নানা অনুষ্ঠানে ডাকা হচ্ছে না। এ প্রবণতা সাম্প্রতিক। এমন ঘটনা ঘটছে যে তিনি অতিথি না হয়েও উপস্থিত হচ্ছেন কোনো অনুষ্ঠানে। অক্টোবর মাসে ‘দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগে গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে কারন দর্শানোর নোটিশ দেয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্যই এই নোটিশ। জাহাঙ্গীর এর জবাবও দিয়েছেন। তবে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে ১৯ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে। ‘কারণ দর্শানোর’নোটিশের পর জাহাঙ্গীর কি উপেক্ষিত হচ্ছেন স্থানীয়ভাবে? কেন্দ্রের কোনো ‘বার্তা’ পেয়েই কি এমনটা ঘটছে?
গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই জানে কেন তারা সিটি মেয়রকে ডাকেনি। আমন্ত্রণপত্রে তাঁর নাম ছিল না, এটা ঠিক।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সকলকে এক অনুষ্ঠানে ডাকা সম্ভব হয় না। আমরা তো এ জেলার আরও দুই সাংসদকেও ডাকিনি। এর ভেতরে অন্য কোনো মানে খোঁজা ঠিক হবে না।’
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গাছের চারা রোপণ করা হলেও মেয়রকে অতিথি করা হয়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এত বড় অনুষ্ঠানে তাঁকে না ডাকা ইঙ্গিত বহন করে নিঃসন্দেহে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মন্তব্যের ঘটনায় কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্ব জাহাঙ্গীরের ওপর রুষ্ট—এমন কথাও বলছেন কেন্দ্রেরই একাধিক নেতা। যদি দল জাহাঙ্গীরের জবাবে খুশি না হয়, তবে সংগঠনের নিয়মে বহিষ্কারও হতে পারেন। এমনটা ঘটতে পারে কী—এ প্রশ্ন এখন জোরোশোরে আলোচিত হচ্ছে।
তবে ঘটনা তো শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিন্তু নয়।
গাজীপুরের সার্কিট হাউস কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় ১৯ অক্টোবর। জেলা প্রশাসন এর আয়োজন করে। এখানে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। জাহিদ হাসানও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে অতিথির তালিকায় নাম ছিল না জাহাঙ্গীর আলমের। পরে অবশ্য তিনি এখানে আসেন।
জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি মেয়রকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। পরে তিনি এখানে আসেন। তাঁকে অতিথি না করার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি।’
একাধিক অনুষ্ঠানে মেয়র যেমন ডাক পাচ্ছেন না, তেমনি তাঁর ডাকেও কেউ আসছে না। ১৮ অক্টোবর গাজীপুরের রাজবাড়ী মাঠে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে মেয়র জাহাঙ্গীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ৫৮ কেজির কেক কাটা হয় সেই অনুষ্ঠানে। সেখানে জেলা পুলিশ বা সাধারণ প্রশাসনের কাউকে দেখা যায়নি। মেয়র অনুষ্ঠান করবেন আর প্রশাসনের কেউ নেই, এমন নজির খুব বেশি দেখা যায়নি এতকাল।
স্থানীয় সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের এমন এড়িয়ে চলার মনোভাব কি বুঝতে পারছেন জাহাঙ্গীর আলম?
এ প্রশ্নে জাহাঙ্গীরের সরাসরি কোনো উত্তর নেই। প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে তো বোঝেনই, একেকজন একেকভাবে চলে। ইচ্ছেমতো। আর আমার বিরোধিরাও নানা কথা রটাচ্ছে।’
মেয়র জাহাঙ্গীরের বিষয়ে দলের সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত কী হতে পারে, তা নিয়ে শাসক দলের একাধিক সাংগঠনিক সম্পাদক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তবে এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান নি। যাঁরা সরাসরি কথা বলেছেন, তাঁদের মূল সুর এক—এ বিষয়ে দলীয় সভাপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাই তাঁর ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে।
একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জাহাঙ্গীরের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে ভিন্নধর্মী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
একদল মনে করেন, জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে জাতির জনক সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছে। এটি দলের অস্তিত্বের প্রতি আঘাত। এটা এমন এক অপরাধ, যা প্রমাণিত হলে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। একটি সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীর জবাব দেওয়ার পর ২১ অক্টোবর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রসঙ্গটি উঠেছে। এ নিয়ে দলীয় সভাপতিও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বলে দলীয় সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য জানান।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৫৭ ধারায় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার বিষয়ে বলা আছে। সেখানে বলা আছে, যেকোনো সদস্য আওয়ামী লীগের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নিয়মাবলি, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে অংশ নিলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ তাঁর বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে।
কেন্দ্রীয় কমিটির ওই সদস্য বলেন, গাজীপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা সম্পর্কে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অসৌজন্যমূলক কথা বলেছেন জাহাঙ্গীর। স্থানীয় আওয়ামী লীগে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ আছে। এরপর এসেছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মন্তব্যের অভিযোগ। এটা প্রমাণিত হলে জাহাঙ্গীর দল থেকে বহিষ্কৃত হতেই পারেন।
জাহাঙ্গীর দেশের বৃহত্তম সিটির মেয়র। তিনি গাজীপুর সিটির দাপুটে নেতা। এত বড় অবস্থানে থেকে দল থেকে বহিষ্কৃত হবেন, এমনটা খুব সহজ বিষয় নয় বলেই ধারণা সভাপতিমণ্ডলীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্যের।
তবে জাহাঙ্গীর বড় সাজা পেতে পারেন বলে যে নেতা মনে করেন তাঁর কথা, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় ড. কামালের মতো নেতাকে দল ছাড়তে হয়েছিল। ক্ষমতায় থাকতে ১৯৯৯ সালে কাদের সিদ্দিকীর মতো বড় নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এসবের বিবেচনায় জাহাঙ্গীর কোনো বড় ফ্যাক্টর নন।
কিন্তু কামাল হোসেন বা কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে এখন জাহাঙ্গীরের ঘটনার কি তুলনা চলে?
এক সাংগঠনিক সম্পাদকের মন্তব্য, ‘ড. কামাল হোসেন বা কাদের সিদ্দিকীর মতো নেতাদের প্রতি কেউ কেউ বিরাগভাজন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। জাহাঙ্গীরের কিন্তু তা নেই। তাঁকে কেন্দ্রের রাজনীতিতে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনেও করেন না। বরং কেন্দ্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জাহাঙ্গীরের খুব সদয়। তাই এ ক্ষেত্রে বহিষ্কারের মতো ঘটনা ঘটবে না বলেই মনে হয়।’
এ নেতার ধারণা, জাহাঙ্গীরকে আসলে এ দফায় সতর্ক করে দেওয়া হবে। বড়জোর সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তাঁকে ছেড়ে দিতে হতে পারে। জাহাঙ্গীরের কথাবার্তায় আঞ্চলিকতার প্রভাব যথেষ্ট। অডিওতে যতটুকু শোনা যায়, তাতেও সেই আঞ্চলিকতার প্রভাব লক্ষ করা গেছে এবং সে কথাও স্পষ্ট নয়। তাই এসব বিবেচনায় তাঁকে এ দফায় ছাড় দেওয়া হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহাঙ্গীর তাঁকে দেওয়া কারণ দর্শানোর জবাব দিয়েছেন। কিন্তু কী জবাব দিয়েছেন, তা প্রকাশ্য হয়নি। তাঁর জবাব পড়ে দলীয় সাংগঠনিক নিয়ম মেনেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর বাইরে কিছু হবে না।’
জাহাঙ্গীরের জন্য কি লঘু শাস্তিই অপেক্ষা করছে তাহলে? প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনি কারণ দর্শানোর নোটিশে কী বলেছেন, তার ওপর নির্ভর করছে সমস্ত বিষয়। উনি যদি ক্ষমা চান, তবে দল তা বিবেচনা করবে বলেই আমার ধারণা।’
জাহাঙ্গীর একাধিকবার বলেছেন, তাঁর বক্তব্য ‘সুপার এডিট করা হয়েছে’। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সবকিছু নেত্রীর (দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা) ওপর ছেড়ে দিয়েছি। তাঁর কাছেই তো জবাব দিয়েছি। জানা মতে, আমি কোনো দোষ করিনি। আমি নেত্রীর ওপর ভরসা করে আছি। উনি দেশে এলেই সব বোঝা যাবে।’
দলীয় সভাপতি তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পথ চেয়ে থাকা দেশের সর্বকনিষ্ঠ সিটি মেয়র কতটুকু সার্থক হবেন, তা ১৯ নভেম্বরের সভাই বলে দেবে। সেই সভা এবং নিঃসন্দেহে সভাপতির সিদ্ধান্তই যে সব, তা সবাই মানেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন সেই বাস্তবতাই স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘১৯ নভেম্বরের সভায় জাহাঙ্গীরের বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানি।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন গাজীপুর প্রতিনিধি মাসুদ রানা)