গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় শহুরে হাওয়ায়
‘বাঁশরিয়া বাজাও বাঁশি দেখি না তোমায়/ গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় শহুরে হাওয়ায়...’ মোনায়েম হোসেন যেন সুমনের এই গানের প্রতিচ্ছবি। এলাকার অনেকে তাঁর চেহারার সঙ্গে পরিচিত, তবে বাঁশির সুরে তাঁকে চেনে প্রায় সবাই।
এ নগরে গাড়ির হর্ন, রিকশার টুং টাং শব্দ, ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, নির্মাণকাজের নীরস শব্দে অভ্যস্ত জীবন। এমন নগর জীবনে পথ চলতে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ বা ‘মিলন হবে কত দিনে...’ গানের বাঁশির সুর শোনার কথা ভাবাটাই যেন অকল্পনীয়। তবে মোনায়েমের কারণে নানা শব্দ ছাপিয়ে তাঁর বাঁশির সুরে এখন অভ্যস্ত রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা। এলাকার অলিগলিতে রিকশা চালাতে চালাতে বাঁশি বাজান মোনায়েম। কখনো দিনে কখনো রাতে কংক্রিটের ফ্ল্যাটে থাকা মানুষকে একঝলকের প্রশান্তি দেয় ওই সুর।
মোনায়েমের সঙ্গে কথা হলো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং এলাকার গণ্ডির বাইরে তাঁর রিকশা গ্যারেজে বসে। মোনায়েম জানালেন, সিরাজগঞ্জে ১৮ বছর ভ্যান চালিয়েছেন। সিরাজগঞ্জে রিকশা নেই, ভ্যানেই লোকজন চলাচল করেন। একটু ভালো আয়ের আশায় পাঁচ বছর আগে এই এলাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন। সাদা-কালো প্লাস্টিকের বাঁশিটি দেখিয়ে বললেন, এটি তাঁর সব সময়ের সঙ্গী। নিজেই বানিয়েছেন।
বাবা মৃত আবদুল জলিল প্রামাণিক এবং মা মরিয়ম বেগম। মোনায়েমরা চার ভাই, দুই বোন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বিনোদপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। স্ত্রী শিউলি খাতুন দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে থাকেন। মেয়ে মহুয়া খাতুন (১৮) তাড়াশ মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছেলে মো. সিয়াম বিনোদপুর দাখিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
মোনায়েম জানান, মায়ের কাছে শুনেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সবে হাঁটা শুরু করেছিলেন। সেই হিসাবে তাঁর বয়স ৫০ বছরের বেশি।
১৫-২০ দিন রিকশা চালিয়ে আয়ের অর্থ নিয়ে সাত দিনের জন্য বাড়ি চলে যান। জমা খরচ ২০০ টাকা দেওয়ার পর প্রতিদিন তাঁর আয় থাকে প্রায় ৫০০ টাকা। রিকশা গ্যারেজে তিনবেলা খান। সে বাবদ দিতে হয় দিনে ১২০ টাকা। কোনো কোনো মাসে বাঁশি বাজানো শিখিয়ে আয় করেন ৭০০-৮০০ টাকা। সে ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা পারিশ্রমিক নেই।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসংলগ্ন ছোলমাইদ আর্মি গ্যারেজের ওপরে টিনের ঘরে থাকেন মোনায়েম। সেখানের দুই রিকশাচালক নুর আলম ও রায়হান জানান, বাঁশির কারণে এই এলাকার সবাই মোনায়েমকে চেনেন। মোনায়েমকে সবাই ‘বাঁশিওয়ালা’ই ডাকেন। প্রায়ই তাঁরা আয়োজন করে মোনায়েমের বাঁশির সুর শোনেন। তবে ইচ্ছা থাকলেও নিজেরা বাজাতে পারেন না।
রিকশা গ্যারেজের ব্যবস্থাপক মো. রুবেল বলেন, তিনি দুই বছর ধরে এই গ্যারেজের দায়িত্বে এসেছেন। তখন থেকেই মোনায়েমের বাঁশির সুর শুনছেন। কেউ কেউ মোনায়েমের কাছে বাঁশি বাজাতে শিখতে আসেন। তিনি যখন মোনায়েমকে নিয়ে বলছিলেন, তখন অন্য রিকশাচালকেরা একযোগে হইহই করে মোনায়েমকে বাঁশি বাজানোর অনুরোধ জানাতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি বাজানো শুরু করেন তিনি।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের একটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী মো. মনির জানান, এই এলাকায় মোনায়েমের বাঁশির সুর শোনেননি, এমন লোক কম আছে। কখনো রিকশায় যাত্রী নিয়ে, কখনো বা খালি রিকশা বাঁশি বাজাতে বাজাতে চালান মোনায়েম।
মোনায়েম জানান, শখের বশে বাঁশি বাজানো শিখেছিলেন। এখন সেটাই হয়ে গেছে নেশা। ওস্তাদের নাম আবদুর রাজ্জাক। নাটোরের ‘রাজ্জাক বাঁশিওয়ালা’।
মোনায়েম বললেন, ‘একসময় খারাপ লাগল, খুব খারাপ লাগল, বাঁশি বাজাই। একসময় মনে খুব আনন্দ, বাঁশি বাজাই। কিছুক্ষণ না বাজালে, কি এক বেলা না বাজালে, পরের বেলা বাজাই, একদিন না বাজালে পরের দিন বাজাই। বাঁশি না বাজালে আমি থাকতে পারি না।’
বাঁশি বাজানোর শখ হলো কেন? জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘তখনো বিয়েশাদি করি নাই। একদিন মেলায় গেছি। ওখানে অনেকে বাঁশি বিক্রি করতে আসে। ওই সময় দুজন বাঁশিওয়ালা নাটোরের রাজ্জাক বাঁশিওয়ালা ও আজিজ বাঁশিওয়ালা মনে হয় বাঁশি বাজায় সেন্টার বরাবর। মনে করেন, রেডিও টিভিতে যে রকম বাজে। ওইটা শুইনে আমি কই যে বাঁশি বাজানো আমি শিখব। অনেকে আছে কোনো রকম পারে, তাও বেচতে আসে মেলায়। রাজ্জাক ওস্তাদ ও আজিজ ভাই ফেরি করে বাঁশি বিক্রি করে।’
মোনায়েমের বাঁশির সুরে চলে তাঁর রিকশার চাকা। মোনায়েম জানান, তিনি হাত ছেড়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালাতে অভ্যস্ত। হাত ছেড়ে বাঁশি বাজিয়ে ১৮ বছর ধরে ভ্যান ও রিকশা চালাচ্ছেন।
বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালালে যাত্রীরা কী বলে? জানতে চাইলে মোনায়েম বলেন, ‘অনেকে বলে বাহ খুব সুন্দর, মামা, বাজান। অনেকে ২০ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা, ২০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা, কখনো-সখনো ২০ টাকার ভাড়া ১০০ টাকা দিয়ে দেয়। এভাবে বাঁশি বাজালে বেশির ভাগ মানুষ মানা করে না। কখনো কয়, বাবা এখন বাজাইও না। বাঁশি পরে বাজাওনি। রিকশা চালাচ্চ। অনেকে একটু ভয় করে, কারও সাথে যদি বাজায়ে দেয়, গাড়ি-ঘোড়ার সাথে।’
মোনায়েম বললেন, সিরাজগঞ্জে দুই বছর ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালিয়েছেন। ওই সময় বাঁশি চালাতে বেশি সুবিধা হতো। যাত্রী নিয়ে রিকশা চালানোর সময় বাঁশি বাজালে শরীরে চাপ পড়ে। বাঁশি বাঁজাতে কষ্ট হয়। এরপরও থেমে যান না। মন চাইলেই রিকশার প্যাডেলে পা রেখে হ্যান্ডেল থেকে হাত ছেড়ে বাজানো শুরু করেন বাঁশি।