নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি। একদিকে বিরোধী দলের সহিংস হরতাল অন্যদিকে সরকারের ধরপাকড়। এ পরিস্থিতিতে জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কী ভাবছে রাজনৈতিক দল? এ সম্পর্কে পড়ুন দুই নেতার মন্তব্য
দেশের রাজনীতিতে যে হঠাৎ করে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, জনগণ গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে, সে জন্য মূলত বিরোধী দলই দায়ী। দুই দফায় ১২০ ঘণ্টা হরতাল পালন করে আবার তারা জনগণের ওপর ৮৪ ঘণ্টার হরতাল চাপিয়ে দিয়েছে।
বিরোধী দল দীর্ঘদিন ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও সেই তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা কী করে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সে সম্পর্কে কোনো ফর্মুলা এখনো পর্যন্ত তারা দিতে পারেনি।
মনে রাখতে হবে, সংবিধানের মৌলনীতির পরিপন্থী বলেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন। এখন এই ব্যবস্থার পুনর্বহাল করা হবে আদালতের রায়ের লঙ্ঘন।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে সর্বশেষ নির্দলীয় সরকারের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা এতটাই অবাস্তব যে তাঁর দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেছেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সম্ভব না হলে সে বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ এটি একটি হাস্যকর প্রস্তাবে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সর্বদলীয় সরকারের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটি যেমন বাস্তবসম্মত, তেমনি সংবিধানের মৌলনীতিরও সমর্থক। আমরা শুরু থেকে বলে এসেছি, যা করার সংবিধানের ভেতরেই করতে হবে; সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন।
সমস্যা সমাধানে বরাবরই আমরা আলোচনার কথা বলে এসেছি। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা ডেকে ৬০ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করে আলোচনার জন্য দুই দিনের সময়সীমা বেঁধে দিলেন। আসলে তিনি সময় দিয়েছিলেন মাত্র ২৪ ঘণ্টা। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বিরোধী দলের নেতার দেওয়া সময়সীমার মধ্যেই তাঁকে টেলিফোন করে ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় গণভবনে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা হরতালের দোহাই দিয়ে সেই আমন্ত্রণ নাকচ করে বলেন, তিনি ২৯ অক্টোবরের পর যেকোনো সময় আলোচনায় বসতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রীর সেই আমন্ত্রণ এখনো বহাল আছে। কিন্তু বিরোধী দল আলোচনার পথে না গিয়ে হরতালের নামে সারা দেশে সন্ত্রাস ও সহিংসতা চালাচ্ছে। বোমা মেরে মানুষ মারছে, যানবাহন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার বলে বিরোধী দল দাবি করে। কিন্তু হরতালের নামে রাস্তায় জবরদস্তি করা, বোমা-ককটেল নিক্ষেপ করে মানুষ মারা, রেললাইন উপড়ে ফেলা কিংবা যানবাহনে আগুন দেওয়া কিংবা জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। এ অবস্থায় জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য সরকার যদি কোনো আইনি পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তাহলে দোষ দেওয়া যায় না। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
এই যে বিরোধী দল হরতালের নামে জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে, তার উদ্দেশ্য কিন্তু নির্বাচন নয়। এসবের মাধ্যমে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করে অন্য কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছে। পাকিস্তান আমল থেকে এ দেশের মানুষ বহু হরতাল দেখেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক হরতালের চিত্র একেবারেই আলাদা।
আগে কখনোই হরতালের আগে থেকে গাড়ি ভাঙচুর বা জ্বালাও-পোড়াও করা হতো না। কিন্তু বিরোধী দল এখন হরতাল ডেকেই গাড়ি ভাঙচুর করতে নেমে যায়। এমনকি গণমাধ্যমের অফিস ও গাড়িও তাদের হামলার শিকার হচ্ছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে এই নৃশংসতা চলতে পারে না।
গত কয়েকটি হরতালের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে জামায়াত-শিবিরই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে। হাইকোর্টের রায়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর দলটি এখন অরাজকতা চালাচ্ছে। এর আগে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে কী ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, তা দেশবাসী জানে।
বিরোধী দলের রাজনীতি এখন আর বিএনপির হাতে নেই, জামায়াত-শিবিরই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিএনপি অতিমাত্রায় তাদের ওপর নির্ভরশীল। গত কয়েক দিনে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। সেটি করা হয়েছে নির্দিষ্ট মামলার ভিত্তিতেই। এর সঙ্গে নির্বাচনী রাজনীতি ও সংলাপকে এক করে দেখা ঠিক হবে না।
এত কিছুর পরও রাজনীতিতে যাতে সুস্থিরতা থাকে, সবাই মিলে যাতে নির্বাচনটি করা যায়, সে জন্য আমাদের আলোচনার প্রস্তাব এখনো বহাল আছে। মনে রাখতে হবে, ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচনের বিকল্প নেই।
অনেকেই বিরোধী দলের অফিসে ও খালেদা জিয়ার বাসভবনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিরোধী দলের নেতার নিরাপত্তার দায়িত্বও সরকারের। সেখানে যদি তাঁর নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে বলে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে—এটাই স্বাভাবিক।
আমরা এখনো চাই বিএনপিসহ সব বিরোধী দল নির্বাচনে আসুক। সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিয়ে তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করুক।
আর যদি বিএনপি একেবারেই না আসে, তাহলেও নির্বাচন হতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে ১৮-দলীয় জোটের অনেক শরিক নির্বাচনে অংশ নেবে। এমনকি বিএনপিরও অনেক নেতা নির্বাচনের দিকেই ঝুঁকে পড়বেন।
ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ।
দেশে জরুরি অবস্থা জারির পাঁয়তারা