করোনার প্রথম ঢেউ অতিক্রান্ত হওয়ার পর এক পড়ন্ত বিকেলে ছাদখোলা এক রেস্টুরেন্টে পরিবারসহ কফির আড্ডায় বসেছিলাম। লক্ষ করলাম, আমাদের খুব কাছাকাছি কয়েকজন ছবি তোলায় ব্যস্ত। তাঁদের প্রত্যেকের বয়স ৪২ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। ছবি তুলতে তাঁরা এতটাই মশগুল ছিলেন যে স্থান-কাল-পাত্রের জ্ঞান হারিয়েছেন যেন। করোনা পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় দূরত্ব তো দূরের কথা, পারলে তাঁরা যেন গায়ের ওপর উঠে ছবি তোলেন। যতক্ষণ রেস্টুরেন্টে ছিলাম, পুরো সময়েই তাঁদের ছবি তুলতে দেখেছি। স্থির হয়ে নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করার যেন সময়ও নেই তাঁদের। এঁদের মধ্যে আমি আমার একজন সাবেক সহকর্মীকেও খুঁজে পেলাম। পোশাকে আর কড়া মেকআপে তিনি যেন অনেকটাই অচেনা। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পরও তাঁর মধ্যে ভাবান্তর লক্ষ না করে নিজেই খানিকটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। সৌজন্য বিনিময়ের হাসিটুকু দ্রুত গুটিয়ে নিয়ে ভাবলাম, কোথাও আমার ভুল হচ্ছে না তো! তবে সেই রাতেই ফেসবুকের ওয়ালে সাবেক সহকর্মীর পোস্ট করা ছবি দেখে নিশ্চিত হই, বিকেলে তাঁকে চিনতে আমার কোনো ভুল হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, বাস্তবে সেদিন তিনি আমাকে এড়িয়ে গেলেও ফেসবুকে তিনি কিন্তু নিয়মিত আমাকে অনুসরণ করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অসম্ভব জনপ্রিয়তা সম্ভবত বাস্তব জীবন আর স্ক্রিনবন্দী জীবনের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিচ্ছে; সেখানকার একটি জীবন চেনে না আরেকটি জীবনকে। একই ব্যক্তির যেন দুটি সত্তা; একটি বাস্তবতার টানাপোড়েনে পরিপূর্ণ আর অন্যটি স্ক্রিনে কৃত্রিম আলোর মতোই ঝলমলে আর চোখধাঁধানো। দুটি জীবনের কুশীলবরা যেন অনেকটাই আলাদা। আমরা সচরাচর শিশু-কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে স্ক্রিনবন্দী জীবনে আসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু আমরা যাঁরা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি, তাঁরা কি সত্যিকার অর্থে এই আসক্তি থেকে দূরে আছি? শৈশব, কৈশোর কিংবা যৌবনের পরিক্রমায় আমরা যে ভালো অভ্যাসগুলো অর্জন করেছিলাম, সেই অভ্যাসগুলো আমরা কি ধরে রাখতে পেরেছি? আমরা নিজেরা কি হারাতে বসিনি সামাজিকতা, মূল্যবোধ আর শিষ্টাচারের শিক্ষা?
শিশু-কিশোর-তরুণদের প্রযুক্তিনির্ভরতা আর মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি নিয়ে আলোচনা হয় বিস্তর। সন্তানদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে অভিযোগ প্রায় প্রতিটি মা-বাবার। কিন্তু এদিকে মা-বাবাই যে মোবাইল আসক্তিতে তলিয়ে যাচ্ছে সেই খবর কি আমরা রাখি? আমরা শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গঠন নিয়ে চিন্তিত, চিন্তিত শিশুদের সুস্থ বিনোদনের চর্চা নিয়ে। অথচ বই পড়ার নেশায় বুঁদ হয়ে আমরা যে প্রজন্মটি বেড়ে উঠেছিলাম, সেই প্রজন্মটি বই পড়া ভুলতে বসেছি।
বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন আহমেদ কিংবা মাসুদ রানা পড়ে বড় হওয়া এই আমরা আজকাল আর বইয়ের অভাব অনুভব করি না। লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়া, নিয়ম করে বিটিভির অনুষ্ঠান দেখা, গলা ছেড়ে কোরাস গান করা কিংবা স্কুল–কলেজের খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে আমরা কি নির্দয়ভাবে নিজেদের সঁপে দিয়েছি মোবাইলের হাতে। কিছু চটকদার খবরের শিরোনাম, টিকটক, পরিচিতদের নিউজ ফিড, কিছু ভিডিও লিংক আর চ্যাটিংয়েই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি নিজেদের জীবন। শিশু-কিশোর-তরুণদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথা হয়, আলোচনা হয়। কিন্তু পরিণত প্রজন্মটির বদলে যাওয়া অভ্যাস নিয়ে কেউ কথা বলে না। অথচ পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে আমাদের মতো পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল আচরণ ও চর্চা খুব জরুরি। আমরা নিজেরাই দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়লে কাদের অনুসরণ করবে শিশু-কিশোর-তরুণেরা?
শিশু-কিশোর-তরুণদের প্রযুক্তিনির্ভরতা আর মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি নিয়ে আলোচনা হয় বিস্তর। সন্তানদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে অভিযোগ প্রায় প্রতিটি মা-বাবার। কিন্তু এদিকে মা-বাবাই যে মোবাইল আসক্তিতে তলিয়ে যাচ্ছে সেই খবর কি আমরা রাখি?
‘আর ইওর প্যারেন্টস অ্যাডিক্টেড টু ফোনস’? শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়। সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক একটি সংস্থা ১০০০ জন মা-বাবা এবং তাঁদের সন্তানের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এতে বলা হয় যেখানে প্রতি ১০ জনে ৬ জন মা-বাবা মনে করেন, তাঁদের সন্তান মোবাইলে আসক্ত, সেখানে প্রতি ১০ জনে ৪ জন সন্তান মনে করে যে তাদের মা-বাবা মোবাইলে আসক্ত। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৮ শতাংশ কিশোর বয়সী মনে করে, তাদের মা-বাবা মোবাইলে আসক্ত। শুধু তা–ই নয়, তারা তাদের মা-বাবার মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তি কামনা করে। এমনকি ৪৫ শতাংশ মা-বাবা নিজেরাই মনে করেন যে তাঁরা মোবাইলে আসক্ত। এই তো গত ডিসেম্বরে জার্মানির হামবুর্গে একদল শিশু মা-বাবার মোবাইল আসক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিল। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সাত বছর বয়সী এমিল আহ্বান জানায়, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে খেলো, স্মার্টফোনের সঙ্গে নয়।’ সাত বছর বয়সী এমিলের সেই আহ্বান কি আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না?
শিশু–কিশোরদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেটের দাবিতে সোচ্চার বড়রা। কিন্তু আমরা বড়রা নিজেরাই অনেকে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার করা থেকে বহু দূরে। আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্য একদিকে যেমন আমরা নিজেরাই হয়রানির শিকার হচ্ছি, অন্যদিকে আমরা অন্যের হয়রানির কারণ হচ্ছি। পাবলিক পোস্টে অনেক সময় দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে চেনা মানুষগুলোর কুরুচিপূর্ণ নোংরা মন্তব্যে আঁতকে উঠতে হয়। এমনকি আমরা আমাদের চ্যাট বক্সগুলো বিশুদ্ধ রাখতে পারছি না। সাইবার বুলিং ইস্যুতে দুশ্চিন্তায় থাকা মানুষগুলো যখন নিজেরাই অন্যের হয়রানির কারণ হয়ে ওঠেন, তখন বড় অসহায় মনে হয় নিজেকে।
আসুন, আমরা বড়রা আগে একবার নিজেদের সুঅভ্যাসগুলোর দিকে ফিরে তাকাই। নিজেরা দায়িত্বশীল হলেই না জন্ম নেবে দায়িত্বশীলতার বার্তা ছড়ানোর অধিকার। আমরা নিজেদের উদাসীনতায় সেই অধিকার হারিয়ে ফেলছি না তো?
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]