আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি নিয়ে বিতর্ক নেই। দেশজুড়ে বিশেষায়িত, জেলা-উপজেলা হাসপাতালও হয়েছে। মেডিকেল কলেজ হয়েছে অনেক। বাংলাদেশ আজ চিকিৎসকের সংখ্যায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। রোগনির্ণয় করতে আর বিদেশে যেতে হয় না। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো—কমিউনিটি ক্লিনিক প্রাথমিক চিকিৎসাকে হাতের কাছে নিয়ে যেতে কাজ শুরু করেছে। এ সবের ফল হলো, গড় আয়ুর ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি।
এর মধ্যেই কোভিড মহামারির বৈশ্বিক প্লাবনে ডুবে গেল পৃথিবী। এই প্লাবনে সে দেশই ভালো করেছে, যাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নৌকা ছিল মজবুত। বাংলাদেশে যখন এই বৈশ্বিক বান এল, তখন দেখলাম, আমাদের তরীটির অনেক ছিদ্র। প্রতিদিনকার মৃত্যু আর ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে গত দুই বছরে দীর্ঘমেয়াদি নৌকা-সারাইয়ের চেয়ে মনোযোগ ছিল কাজ চালিয়ে নেওয়াতে। আজ যখন মনে হচ্ছে যে কোভিড আপদ সহসাই বিদায় নেবে, তখন হয়তো সেই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা শুরুই করা যায়। সেই চিন্তার মূলে জল ঢালার জন্যই এই লেখা।
২০২০ সালের মার্চ থেকেই যখন করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিল, আমরা দেখলাম অনেক হাসপাতালেই আইসিইউ নেই, বা থাকলেও বিকল, নেই অক্সিজেন, ডাক্তার, নার্স। ডাক্তার-নার্স থাকলে নেই পিপিই। এসব রসদ যাও জোগাড় হলো, পড়ে রইল গুদামে। প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতায় টিকার জোগান হলেও সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর এল না। এর মধ্যে আইসিইউ বা রেফ্রিজারেটর নেই ব্যাপারটা দেশের অর্থনীতি দিয়ে ঢাকা গেলেও, অন্য সমস্যাগুলো স্বাস্থ্য খাতের প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতার পরিচায়ক। আর ব্যাপকভাবে সামনে এল স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি—সরকারি ডাক্তার, কর্মী কিংবা বেসরকারি ক্লিনিক মালিক, অনেকেই দুর্নীতির দায়ে সংবাদের শিরোনাম হলেন।
আমাদের দেশে কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি অভাবটি আবার সামনে এল। তাই বন্ধ বা আস্থাহীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে না গিয়ে, কম বা গুরুতর সব ধরনের উপসর্গ নিয়েই রোগীরা ভিড় করলেন হাসপাতালে। এ কারণে অনেকেই জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হলেন। তবে এ সময়ে ত্রাতার ভূমিকায় সামনে এল ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা। সরকারি ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তবে এ ক্ষেত্রেও সুশাসন ও জবাবদিহির অভাব কথাটা উঠে এল নিয়মিতভাবেই।
কোভিড প্লাবনের মধ্যেই দেশে গুজব, মিথ্যা ও আজগুবি তথ্যের জোয়ার বইল। এই জোয়ার মোকাবিলা ও ঘরে ঘরে গিয়ে কোভিড রোগী চিহ্নিত করতে বেসরকারি সংস্থাগুলোর তৎপরতার চাহিদা প্রকট হলো। তবে এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াল পরিকল্পনা, আগ্রহ ও অর্থের অভাব—বিশেষ করে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা স্থানীয় সংগঠনের জন্য। তবে ঠিক অভাব না, কী শর্তে বেসরকারি সংস্থা কাজ করবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা। বিদেশি সংস্থা থেকে পাওয়া অনুদান সরকারের কাছে অব্যয়িতভাবে পড়ে রইল।
কোভিড প্লাবনের মধ্যেই দেশে গুজব, মিথ্যা ও আজগুবি তথ্যের জোয়ার বইল। এই জোয়ার মোকাবিলা ও ঘরে ঘরে গিয়ে কোভিড রোগী চিহ্নিত করতে বেসরকারি সংস্থাগুলোর তৎপরতার চাহিদা প্রকট হলো। তবে এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াল পরিকল্পনা, আগ্রহ ও অর্থের অভাব—বিশেষ করে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা স্থানীয় সংগঠনের জন্য। তবে ঠিক অভাব না, কী শর্তে বেসরকারি সংস্থা কাজ করবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা। বিদেশি সংস্থা থেকে পাওয়া অনুদান সরকারের কাছে অব্যয়িতভাবে পড়ে রইল।
এ সময় সামনে এল রোগ প্রতিকারের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে রোগ প্রিভেন্টিভ কেয়ারের ক্ষেত্রে দেশের পিছিয়ে থাকার ব্যাপারটি। মানসিক স্বাস্থ্য, রোগপ্রতিরোধমূলক শারীরিক যত্ন, পুষ্টি সহায়তার মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবার প্রাপ্যতা ও মন—দুই-ই করোনার অভিঘাতকে আরও দুঃসহ করে তুলেছিল।
যা হওয়ার হয়েছে। ভালো খবর হলো, সাহসী রাজনৈতিক পদক্ষেপে আমাদের দেশ পরিস্থিতি অনেক ভালোভাবে সামলেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এখন সামনে আসা ‘সমস্যা’ ও ‘অপ্রতুলতা’ সারিয়ে তুলে দেশের স্বাস্থ্য-তরীকে মজবুত করা। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে নীতিনির্ধারকদের সদয় বিবেচনার জন্য তুলে ধরব।
গত দুই বছরে পত্রপত্রিকায় ও বিভিন্ন গবেষণায় আসা স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের যে অভাবের কথা এসেছে, সেগুলোর নির্মোহ বিশ্লেষণ করে প্রতিকার দরকার। বাধা হিসেবে যে সমন্বয়ের অপ্রতুলতা বারবার চোখে পড়েছে, তা একাধিক মন্ত্রণালয়, যেমন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, জেলা-উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমেই হোক কিংবা সিভিল সার্জন ও বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালকের মাধ্যমেই হোক,౼তা নির্ধারণ করে দূর করা জরুরি।
স্বাস্থ্য খাতে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে একটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যুগোপযোগী একটা কাঠামো কেমন হওয়া উচিত, সে ব্যবস্থায় কী ধরনের পেশাদারি দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তার উত্তর খুঁজতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন দেশের মডেল তো আছেই, দেশেও সামরিক চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
চিকিৎসাসেবা-সংক্রান্ত আমাদের আইনকানুনের সংখ্যাধিক্য আছে, কিন্তু কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। তার ওপর ডিজিটাল চিকিৎসাব্যবস্থায় প্রবেশের প্রাক্কালে এই আইনি কাঠামো অপ্রতুল। এসব আইন-কাঠামোর একটি ‘সিস্টেমেটিক রিভিউ’ও পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন রয়েছে।
কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা ছাড়া কোনো আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা ভাবা যায় না—আমাদের দেশের অভাবনীয় দুরবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি। কীভাবে এই ব্যবস্থা কাজ করবে, এ নিয়ে অতীতে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে, অগ্রগতি হয়নি। ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড নিয়ে অগ্রগতি সীমিত। এই কাজ দুটিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ে তুলতে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। শুনেছি জেলায় জেলায় জনস্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে ইতিমধ্যেই জনবল কাঠামো নির্ধারণের কাজ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঢিমেতালে চলন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মানসিক স্বাস্থ্যর উন্নয়নের জন্য সরকার ইতিমধ্যেই একটি কৌশল গ্রহণ করেছে। আমি সর্বান্তকরণে আশা করি, এ কৌশল বাস্তবায়নে আমরা দ্রুতগতি দেখব।
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সবচেয়ে প্রধান ও প্রথম দায়িত্ব সরকারের। তবে বেসরকারি খাতের প্রয়োজনীয়তা আমরা কোভিডকালে দেখেছি। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে আন্তরিক সাধুবাদ যে ব্র্যাকের মতো বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থাকে তারা আন্তরিকভাবে কাছে টেনে নিয়েছে। তবে এই আপত্কালীন মেলবন্ধনকে আরও সুসংগঠিত করার ও বিস্তৃত করার সুযোগ ও দরকার দুই-ই রয়েছে, যাতে এসব সংগঠন আমাদের জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার নিবিড় অংশ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে, যেখানে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো অপরিহার্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
শেষ কথা, আমরা আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা দিয়ে কোভিড অনেক ভালোভাবে উতরেছি ভেবে বসে থাকা উচিত হবে না। বরং যে দুর্বলতাগুলো কোভিডকালে বের হয়ে এসেছে, সেগুলো দূর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ২০৪২ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার পথে জনগণের চাহিদা বাড়বে, আর কোভিডের মতো মহা প্লাবন আবার ফিরে আসার আশঙ্কাও বাড়বে বই কমবে না।
কে এ এম মোর্শেদ ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক