সৌদি আরবে মি. ট্রাম্পের পুনর্জন্ম!
সৌদি আরবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্জন্ম ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, কোনো শান্তির দেবদূত কিংবা নোবেল পুরস্কার জয়ীর যুদ্ধবিরোধী ভাষণ শুনছি। অনেকেই বলবেন এবং তা সঠিক যে, তিনি সৌদি আরবে সমরাস্ত্র বিক্রির বড়সড় একটি চুক্তি করেই তবে যুদ্ধবিরোধী বক্তৃতা করেছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গিগত বিরাট পরিবর্তন একটি নতুন ঘটনা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা পর্যায়ক্রমে সংস্কার দেখতে চাইব, কোনো হস্তক্ষেপ নয়।’ এখন কোটি টাকার প্রশ্ন দাঁড়াবে, যে আমেরিকা হিরোশিমা নাগাসাকির জন্ম দিয়েছে, যে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধে মৃত্যুর বাণ ডেকেছে, যে আমেরিকা আল-কায়েদা তৈরি করেছে, সেই আমেরিকার মৃত্যু ঘটেছে কি না? ৫০টির বেশি মুসলিম দেশের নেতৃবৃন্দের সামনে ট্রাম্প আমাদের সামনে কোন আমেরিকাকে উপস্থাপন করেছেন?
তবে কোনো সন্দেহ নেই, ট্রাম্পের ভাষণ সুলিখিত, সুচিন্তিত। যাতে মুসলিম সভ্যতার প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সেটা অবশ্যই একটি সুখবর। আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানাই।
ট্রাম্পের বক্তৃতার পরতে পরতে তিনি সচেষ্ট থেকেছেন, এরপর যাতে ‘ট্রাম্প ও ইসলাম’ নামে একটি নবতর আলোচনার ধারার সূচনা ঘটে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মিসরের সেই আলোচিত ভাষণের একটি কথা মনে পড়ছে। সেই ভাষণে তিনি পবিত্র কোরআন থেকে প্রচুর আয়াতের বরাত দিয়ে ইসলামকে একটি শান্তি ও প্রগতির ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। মুসলিম শাসনামলে সভ্যতা কী কী অনন্যসাধারণ আবিষ্কার ও উদ্ভাবন প্রত্যক্ষ করেছে, তার বিবরণ দিয়েছিলেন। ওবামা বলেছিলেন, একটি ভাষণ দিয়ে ইসলাম বনাম পাশ্চাত্য যে ব্যবধান, তা দূর করা যাবে না। তবে ওবামার কায়রো ভাষণের মতো ট্রাম্পের ভাষণেও যে মৌলিক দিকটি অনুপস্থিত, তা হলো ইসলাম বনাম পাশ্চাত্য এই ধারণাটি যে মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ, সেদিকে একেবারেই আলোকপাত না করা। ‘ওয়েস্ট’ কিংবা ‘ইসলামি’ শব্দ উচ্চারণ করার পরে পোশাকের মতো সংস্কৃতি বা লৌকিকতার যে দিকটি যত দ্রুত পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে, শাসন-পদ্ধতিগত দিকটি সেভাবে ফুটে ওঠে না। ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংবিধানের যে ধারক-বাহকেরা মি. ট্রাম্পের সামনে বসেছিলেন, তাঁদের ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিগত শাসন-পদ্ধতিকে অনেক সময় ‘ইসলামি শাসন’ হিসেবে তাঁরা দাবি করে থাকেন। সুতরাং, এই ইসলামি শাসনের সঙ্গে যে ‘সংঘাত’, তাকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে সংঘাত বলে চালানো কতটা সমীচীন, সেটা একটা প্রশ্ন।
যা হোক, ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি মি. ট্রাম্পের আগের রূঢ় ও অসংগত অবস্থান থেকে সরে আসা কতটা বাহ্যিক, কতটা বাগাড়ম্বর, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে। কারণ, তিনি তাঁর বক্তৃতা ও কর্মে অতিশয় নিষ্ঠাবান, এমন রেকর্ড তাঁর দুর্বল। তদুপরি আমেরিকা এবং তার চারপাশের কট্টরপন্থীরা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সেটা বুঝতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
‘রেডিক্যাল ইসলামিক টেররিজম’ ছিল ট্রাম্পের সবচেয়ে প্রিয় শব্দ। এই কথা বাদ দেওয়া এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইকে ‘শুভ ও অশুভ শক্তির মধ্যকার লড়াই’ হিসেবে দেখিয়ে তিনি বিশ্বকে একটি সঠিক বার্তা দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম বিদেশি রাষ্ট্র সফরে সৌদি আরবকে বেছে নেওয়া এবং সেখানে তাঁর পায় ১৮০ ডিগ্রি সরে আসার মতো পদক্ষেপ দুটি বার্তা দিচ্ছে। প্রথমত, তিনি তাঁর ইসলাম ফোবিয়া ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা করে এবং প্রেসিডেন্টের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের প্রবেশাধিকারে কড়াকড়ি আরোপ করে যে ভুল করেছিলেন, তাতে তিনি একটা ভারসাম্য আনতে চেয়েছেন। অন্তত ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি বুঝেছেন, আমেরিকার বাণিজ্যিক ও কৌশলগত স্বার্থ আদায়ে তাঁর নীতি আমেরিকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে না। দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সে মেরি লিপেনের পরাজয় তাঁকে দেখিয়েছে, তার অনুসারী মিত্ররা বহির্বিশ্বে ইসলাম ফোবিয়া বিকিয়ে ফায়দা নিতে পারছে না। সুতরাং, যে নীতি তাঁকে ক্ষমতায় এনেছে, সেটা তাঁকে বিশ্বপুলিশের ভূমিকা পালনে সুবিধা দেবে না। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান যে অবশিষ্ট বিশ্বের কাছে আমেরিকাকে একঘরে করে তুলতে পারে, সেটাও তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা বিবেচনায় নিয়েছেন।
মিশেল ওবামার মতোই মেলানিয়া ট্রাম্পকে সৌদির রীতি অনুযায়ী স্কার্ফ পরতে দেখা যায়নি। আর এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে সৌদি আরব এতে আহত বোধ করেনি। তারা বিষয়টিকে যথার্থই পোশাকের স্বাধীনতা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মেনে নিয়েছে।
যদিও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইসলাম ও আমেরিকার মধ্যে যে কোনো টানাপোড়েন নেই, সেটা বোঝাতেই সৌদি আরবকে তিনি প্রথম গন্তব্য বেছে নিয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প ও তাঁর ইসলামবিষয়ক মতাদর্শ যে আমেরিকার নিজের অবস্থান নয়, সেটা নিউইয়র্ক টাইমস তার সম্পাদকীয়তে বলেছে। পত্রিকাটির মতে, এটা প্রধানত ট্রাম্পের নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ ও কৌশল নির্ধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এটা লক্ষণীয়, আমেরিকান বা পশ্চিমা মিডিয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তনকে তাঁর ভাষণ শুরুর অনেক আগ থেকেই হাইলাইট করতে শুরু করে। অর্থাৎ, তারাও ট্রাম্পের নতুন অবস্থানকে সুনজরে দেখেছে। ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যর আগেই তাঁর বক্তব্যের কপি, যেটা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে তাঁর পিছু হটাকেই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ট্রাম্পের রিয়াদ বক্তৃতার ধারাবাহিকতায় ইসলামি ফোবিয়া বিস্তারের যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, এর অপনোদনে তিনি বিশ্বব্যাপী মার্কিন মিশনগুলোকে কী পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেন এখন এটা দেখার বিষয়। ভিশন ২০৩০ কথাটি শুনে বেশ লাগল। মি. ট্রাম্প বলেছেন, সৌদি আরব যে ভিশন ২০৩০ প্রকাশ করেছে, তাতে ‘সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা, নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে’ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মি. ট্রাম্প ‘ইসলামি বিশ্বের’ সংবেদনশীলতাকে সর্বোচ্চ সংযম ও সতর্কতার সঙ্গে দেখেছেন। রেডিক্যাল ইসলামিক টেররিজম কথাটির অবিশ্রান্ত ব্যবহারকারী ট্রাম্প এবারে ইসলামিক মিলিট্যান্ট বা ইসলামিক এক্সট্রিমিস্ট কথাটিও ব্যবহার করেননি। যদিও তাঁর খসড়া ভাষণে শেষোক্ত কথাটি ছিল বলে সিএনএন খবর দিয়েছিল। সবার মনে পড়বে, ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ—এই পরিভাষা ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার সমালোচনা করেছেন। সেদিক থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর রিয়াদ ভাষণের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ইসলাম শব্দটিকে জড়িত না করে কার্যত শুধু প্রেসিডেন্ট ওবামাই নন, তিনি বহুল আলোচিত রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাতারেও নিজেকে কিছুটা শামিল করেছেন। মি. পুতিন কখনোই ইসলামি সন্ত্রাসবাদ শব্দটি ব্যবহার করেননি।
দুই বছর আগে মি. ট্রাম্পকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ইসলাম অন্তর্গতভাবে শান্তিপূর্ণ কিংবা সহিংস ধর্ম বলে তিনি মনে করেন কি না? তখন তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন, তাতে অনুমেয়, রাষ্ট্র, সরকার এবং কোনো দেশের জনসংখ্যা দিয়ে যে ইসলামের প্রতিনিধিত্বশীলতার বিষয়টি নিশ্চিত হয় না, সেটা তাঁর বিবেচনায় ছিল না। তাঁর উত্তর ছিল, ‘অনেক মুসলমানের কাছে আমরা পছন্দের পাত্র নই।’
অনেক মুসলিম দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত অবস্থানকে অনেক সময় ধর্মের পরিচয় দিয়ে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। অনেক সময় সেটাই ভুল বোঝাবুঝির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন সৌদি নেতৃবৃন্দ ১১০ বিলিয়ন ডলারের যে সমরাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি এ সফরে করেছেন, সেখানে সৌদি কর্তৃপক্ষ যেমন, তেমনি মি. ট্রাম্প ও তাঁর সফরসঙ্গীরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে যে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, তা প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো রাখঢাক করতে দেখা যায়নি। সৌদি গেজেট মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাতে শিরোনাম করেছে, ইরানের অশুভ তৎপরতা নস্যাৎ করতে সমরাস্ত্র ক্রয়চুক্তি সই।
মি. ট্রাম্প মুসলিম ঐতিহ্য চিত্রিত করেছেন। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ইরানেরও প্রশংসা করেছেন। কিন্তু আসাদকে টিকিয়ে রাখতে ইরানের বর্তমান সরকারের চেষ্টার কঠোর সমালোচনা করেছেন। এমনকি সেই সর্বনাশা রেজিম চেঞ্জের ইঙ্গিতও সেখানে আছে। তিনি সুন্নি ইসলামের কাছে গেছেন শিয়া ইরানকে বিচ্ছিন্ন করার আবেদন জানিয়ে। এটাই তাঁর ভাষণের ধূসর দিক।
তবে সার্বিক বিচারে সবকিছু ছাপিয়ে একজন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্জন্মই আমরা আপাতত প্রত্যক্ষ করি। সেটা আমাদের মুগ্ধ করেছে। মনে পড়ছে, বারাক ওবামার একটি উক্তি, মি. ট্রাম্পকে খাটো করে দেখা যাবে না।