সোনারগাঁয়ের লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে মাসব্যাপী লোক উৎসব শুরু হয়েছে। সেখানকার অনুষ্ঠানে দাবি উঠেছে ‘ফোকলোর ইনস্টিটিউট’ ও ‘ফোকলোর জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার। বক্তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, একালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের জোয়ারে দেশে এযাবৎ গড়ে ওঠা সব ঐতিহ্যই হারিয়ে যাবে। তাঁরা জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ‘আঙ্কটাড’-এর বাণিজ্য ও বিনিয়োগের আন্তর্জাতিক উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কল্যাণ হবে তো কেবল উন্নত দেশগুলোর। পক্ষান্তরে হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তৈরি হয়ে এসেছে, তা হুমকির সম্মুখীন হবে।
ভূতাত্ত্বিক-ভৌগোলিক পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ, মানুষের রুচি-চাহিদার পরিবর্তন, পেশা বদল প্রভৃতি নানা কারণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। দেশের অনেক নদীই পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষাকালে কিছু নদীতে যন্ত্রচালিত নৌকা চলে মাত্র। পালতোলা, গুনটানা নৌকা নদীতে ভাসে না। এতে করে হারাচ্ছে নদীর গান—ভাটিয়ালি। উত্তরাঞ্চলের সমৃদ্ধ লোকগান ভাওয়াইয়ারও চর্চা বন্ধ —মেঠোপথ, বন্ধুর পথে গাড়োয়ানের গরু-মোষের গাড়ি চলে না। সেখানকার এশিয়ান হাইওয়েতে চলে যান্ত্রিক শকট। ১০ দিনের পথ ১০ ঘণ্টায় নিশ্চিন্তে পৌঁছা যায়। সুন্দরবন উজাড় হওয়ায় মৌয়াল, বাওয়ালি, কাঠুরিয়াদের বনবিবি, বনদুর্গা, গাজিপীর, দক্ষিণ রায়ের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। রুচি-চাহিদা পরিবর্তন এবং টেকসই না হওয়ার দরুন প্রত্যন্ত গ্রামেও কাঁথা, পাটি, মাদুর, শিকা, ধাতুর তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে যশোর-ফরিদপুরের বাহারি নকশিকাঁথা, সিলেটের শীতলপাটি, ধামরাই-কাগমারীর তামা-কাঁসার বাসন। মাটির হাঁড়ি-কলসির জায়গায় স্থান পেয়েছে অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র। বিলুপ্তির প্রহর গুনছে রাজশাহীর বর্ণাঢ্য শখের হাঁড়ি আর পাবনা-ময়মনসিংহ-ঢাকার রায়ের বাজারের কুমারদের মৃৎশিল্প। যদিও ঢাকার রায়ের বাজারের কুমারদের যুগের চাহিদামতো মাটির তৈরি লালন, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেট ভালো বাজার পেয়েছে। এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এগুলো বিদেশে রপ্তানি করে তাঁরা প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা উপার্জন করছেন। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে চাষের জমিতে এখন আর লাঙলের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। কাবাডি, হাডুডু, গোল্লাছুট, এক্কা-দোক্কা খেলার জায়গা এখন ক্রিকেটের দখলে। কবিরাজি তন্ত্রমন্ত্রের চিকিৎসার কদর নেই। দিঘি-জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিলুপ্ত হয়েছে লোকশ্রুতি কিংবদন্তি। যাত্রাগান হয় না। যাত্রাগানের নামে যা হয়, ব্যাকরণগত অর্থে তাকে যাত্রাগান বলা চলে না। চলচ্চিত্রের প্রচলন হওয়ায় পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ কিংবা পটচিত্রকরেরা পেশা হারিয়ে ফেলেছেন।
এসব কারণেই দাবি এসেছে দেশে ফোকলোর ইনস্টিটিউট ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠার। জীবদ্দশায় দেশের দুই কৃতী লোকবিজ্ঞানী অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম ও অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন ফোকলোর ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য যথেষ্ট তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পায়নি। খ্যাতিমান ফোকলোর বিশেষজ্ঞ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানকে ফোকলোর ইনস্টিটিউট বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলতে দেখেছি। অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, এ ধরনের ব্যক্তিদের অগ্রণী করে সরকার এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
ইংরেজ শাসনামলে ইউরোপীয় মিশনারি, ব্রিটিশ সিভিলিয়ান, দেশীয় সংগ্রাহক এবং পণ্ডিতেরা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংগ্রহ ও চর্চার লক্ষ্যে ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপন করে কাজ শুরু করেন। দেশভাগের পর উভয় বাংলায়ই সে কাজ অনেকটা স্তিমিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে সবার প্রত্যাশা ছিল, আমাদের অতীত ঠিকানা রক্ষার জন্য ওই সব কাজ শুরু হবে। আদতেই ফোকলোরের সংগ্রহ, সংরক্ষণে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগই অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একটি প্রশংসনীয় কাজ করে গেছেন। তিনি মুসলিম বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে ১৯৭৫ সালে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে সেই শূন্যতা কিছুটা পূরণ করে গেছেন। সোনারগাঁয়ে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে কারুপল্লি, ক্ষুদ্রাকার বাংলাদেশ এবং লোকশিল্প জাদুঘর। বিশিষ্টজনেরা বলছেন ওই সোনারগাঁয়েই তো স্থাপিত হতে পারে ‘ফোকলোর ইনস্টিটিউট’ ও ‘ফোকলোর জাদুঘর’।
দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এখানকার লোককবিরাই সবার ওপরে মানুষকে স্বীকৃতিদান করেছেন। জীবনভর মানুষকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন সাধক কবি লালন শাহ। এখানকারই এক অজ্ঞাত লোককবি লিখেছেন: ‘নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ/ জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।’
এমন অমূল্য বাণী রচনা করেন যে কবিরা, তাঁদের স্মৃতি রক্ষার দায় কি নেবে না জাতি?
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]