৮ এপ্রিল প্রথম আলোর বিশাল বাংলা পাতায় প্রকাশিত ‘বেত্রাঘাতে ১৬ শিক্ষার্থী আহত’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বগুড়া শহর, শেরপুর উপজেলা ও ঠাকুরগাঁও সদরে চারটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পিটুনিতে ১৬ জন শিক্ষার্থী গুরুতর জখম হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জনই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।’ কারণ অতি নগণ্য! ঠাকুরগাঁওয়ে টাকার জন্য স্কুল ইউনিফর্ম কিনতে না পারায় শিক্ষক এক শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাতে আহত করেছেন। বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা প্রি-ক্যাডেট হাইস্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থী সম্রাট হোসেনকে বেত্রাঘাতে রক্তাক্ত করেছেন খণ্ডকালীন এক শিক্ষক! সম্রাটের দোষ, ‘খণ্ডকালীন শিক্ষক’কে গল্পগুজব না করে পাঠদান করার জন্য অনুরোধ করেছিল সে। বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার বিশ্বা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় এবং কল্যাণী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক ১৪ জন শিক্ষার্থীকে বেত দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেছেন।
উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে উদ্বিগ্ন হই। শিক্ষকেরা কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করেন? এই একুশ শতকেও কেন বিদ্যালয়ে বেত থাকে? এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের মাথায় ইট মারা, শিকল দিয়ে মারা, চুল কেটে দেওয়া, বিবস্ত্র করা ইত্যাদি। নির্যাতনকারী শিক্ষকদের মধ্যে স্বয়ং প্রধান শিক্ষকও থাকেন। অথচ তাঁর দায়িত্ব হলো, কোনো শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে জখম না করেন, শাস্তি না দেন, তা দেখা এবং শিক্ষকদের সব কার্যক্রম শ্রেণীকক্ষে পাঠদান, অ্যাসেমব্লি, খেলাধুলা তত্ত্বাবধান করা। অথচ বগুড়ার ঘটনায় উল্টো চিত্রই দেখা যাচ্ছে। বগুড়ার শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়ার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন চিত্র নয়। সারা দেশেই কমবেশি তা ঘটে চলেছে।
স্কুল, মাদ্রাসার শিক্ষকদের নির্মম নির্যাতনের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে পার্থক্য নেই। ছেলে শিক্ষার্থীদের মতো মেয়ে শিক্ষার্থীদেরও নির্যাতন করা হয়। সরকার বিদ্যালয়ে শাস্তি কমানোর জন্য বিধিবিধান করেছে। তার প্রয়োগ কতখানি হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা কতখানি সুফল পাচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো নজরদারি আছে কি? যদি তা না থাকে, তাহলে কেন নেই? তাহলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিধিবিধান করার কী অর্থ হয়?
এ কথা সত্য যে কিছু কিছু শিক্ষার্থী খুব দুষ্টু ও চঞ্চলপ্রকৃতির হয়ে থাকে। তারা শ্রেণীব্যবস্থাপনার কাজে বিঘ্ন ঘটায়, যে কারণে অন্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু সে জন্য তাদের শারীরিক নির্যাতন করা কোনো কাজের কথা নয়। শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো শিক্ষকদের জানতে হবে, তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। নির্যাতন ছাড়াই তাদের নেতিবাচক আচরণ থেকে নিবৃত্ত করার উপায় শিক্ষকদের জানতে হবে। শিক্ষককে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, কেন কোনো শিক্ষার্থী স্কুল ড্রেস পরে আসে না বা পরতে পারে না, কেন সে খেলাধুলা করে না, কেন মনমরা, কেন অসুস্থ, কেন অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভালোভাবে মেশে না বা মিশতে পারে না, কেন শ্রেণীর কাজে অংশ নিচ্ছে না, পরীক্ষায় ভালো ফল করছে না ইত্যাদি।
যে শিক্ষকের নিজের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, তিনি কী করে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করবেন? যে শিক্ষক বেত্রাঘাত করে শিক্ষার্থীদের
রক্তাক্ত করেন বা এমনকি যাঁর নির্যাতনের কারণে কোনো শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়, তাঁর শাস্তি হওয়া দরকার। শুধু সাময়িক বরখাস্ত, বদলি বা বেতন স্থগিত রাখলেই এর সমাধান হবে না। কারণ, এই মানসিকতার শিক্ষকদের এ ধরনের কাজ করার প্রবণতা থাকে। তাঁকে বদলি করে যেখানেই পাঠানো হবে, সেখানেই তিনি এমন আচরণের পুনরাবৃত্তি করবেন। শাস্তি দেওয়া হলে তাঁদের আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে, এবং অন্যরাও নির্যাতনের প্রবণতা ত্যাগ করতে সচেষ্ট হতে পারেন।
শিক্ষকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে গলদ রয়েছে বলে আমরা নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক তৈরি করতে পারছি না। ভালো ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের গুণাবলি জন্মসূত্রে পাওয়া যায় না, তা অর্জন করতে হয়। সে জন্য উত্তম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। আমাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আচরণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায় না। শিক্ষকতা যাঁদের ব্রত, তাঁদের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের জন্য; সমাজের জন্য উৎকৃষ্ট মানুষ ও দক্ষ নাগরিক গড়ে তোলা। শিক্ষক শিক্ষার কারিকুলামে জ্ঞান, দক্ষতা বিকাশের ওপর যতখানি জোর দেওয়া হয়, ততখানি গুরুত্ব শিক্ষকের ব্যক্তিগত মানবিক গুণাবলি অর্জনের। দয়ামায়া, স্নেহ-মমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, ধৈর্য, অনুকম্পা, সহনশীলতা, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
আর যেহেতু শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেহেতু যেসব শিক্ষক এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করবেন, তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া ও তাঁর শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা বিদ্যালয়গুলোয় সুস্থ, সুন্দর, শান্তিময় পরিবেশ চাই, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের হাতে মার খাবে না, মানসিক পীড়নের শিকার হবে না। সুন্দর, নির্যাতনের ভয়মুক্ত পরিবেশে মানসম্মত শিক্ষা চাই, দেশের জন্য আলোকিত মানুষ তৈরি করতে চাই। আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে আমরা শিক্ষকেরা সবাই যেন ভালো শিক্ষক হই এবং তার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করি।
সালমা আখতার: অধ্যাপক ও সাবেক পরিচালক, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।