প্রথম আলোর সাহসী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের একটাই অপরাধ—তিনি একের পর এক দুর্নীতি ও অনিয়মের অন্ধকার জগৎটাকে আমাদের সামনে খুলে ধরেছেন। এতে আমাদের লাভ হয়েছে, দেশের লাভ হয়েছে। কোটি টাকার অপচয় আটকানো গেছে। অযোগ্য লোক উৎকোচ দিয়ে চাকরি লাভ করলে তাদের অযোগ্যতার মাশুল গুনতে হতো আমাদের সবাইকে, দেশকে। সেটা ঠেকানো গেছে। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে তাদের, যারা পুকুরচুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। এদের কেউ কেউ হয়তো ইতিমধ্যে বড় ধরনের ‘বিনিয়োগ’ করে বসে আছে, অপেক্ষায় ছিল ঘরে মুনাফা তোলার। সব ভেস্তে দিল মেয়েটা। এরা তো ক্ষিপ্ত হবেই।
সমস্যা হলো, যে কাজটা খুব সহজে সারা যাবে বলে যারা ভেবেছিল, তারা একথা ভাবেনি যে এই ঘটনা নিয়ে দেশে-বিদেশে এমন তোলপাড় হবে। রোজিনার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশের ভেতরে সাংবাদিকেরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। বিদেশের প্রায় সব প্রধান সংবাদপত্রে রোজিনাকে গ্রেপ্তারের নিন্দা করা হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট–এর খবরের শিরোনাম হয়েছে, লুটপাটের খবর প্রকাশ করায় বাংলাদেশি সাংবাদিক গ্রেপ্তার। শুধু যে হিউম্যান রাইটস ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ঘটনার নিন্দা করেছে তা–ই নয়, জাতিসংঘ পর্যন্ত এই নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উত্তাপ এখনো মিইয়ে আসেনি। কোথাও কোথাও এখনো বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে প্রশংসাসূচক রচনা প্রকাশিত হচ্ছে। এই সেদিন নিউইয়র্ক টাইমস–এর নামজাদা সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টফ প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে কীভাবে জেতা যায়, তার শিক্ষা বাংলাদেশের কাছ থেকে গ্রহণ করুন। আর এখন রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের পর সবাই দেশটার দুর্নীতি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অভাব নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন।এমন অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া হবে সম্ভবত সে কথা হিসাবে নিয়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা এমন কাণ্ড করেননি। অনুমান করি, তাঁদের কেউ কেউ এখন নিজেদের হাত কামড়াচ্ছেন।
রোজিনার গ্রেপ্তারের ভেতর দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যে আইনের জোরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার নাম অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট। এই আইন নিয়ে এর আগে খুব একটা কথা শোনা যায়নি। যদ্দুর জানি, এই আইন ব্যবহার করে এর আগে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বা কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়নি। সরকারি গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে এই আইনের অধীনে সরকার চাইলে কার্যত যেকোনো লোককেই—শুধু সাংবাদিক নন—দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে জেলে পুরতে পারে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এমনকি ফাঁসিতেও ঝোলাতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের ঝুলিতে অবশ্য আরও একটি ধারালো অস্ত্র রয়েছে, তার নাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ২০১৮ সালে গৃহীত এই আইনে এমন সব ধারা-উপধারা রয়েছে যে মুখ দিয়ে টুঁ–শব্দটি করলেও সরকার চাইলে তাতে অপরাধ খুঁজে পেয়ে কাউকে জেলে পুরতে পারেন। ফেসবুকে কটু মন্তব্য বা ফ্ল্যাশ ড্রাইভে তথ্য বিনিময় করলেও একই শাস্তি।
এই দুই কালাকানুনের পাশাপাশি রয়েছে ‘রাইট টু ইনফরমেশন’ বা তথ্যের অধিকার আইন, যা বাংলাদেশে ২০০৯ সালে আইন হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এই আইন, যার লক্ষ্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা, তার মুখবন্ধে দেশের মানুষকে এই বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, এই আইনের ফলে সরকারের কাজকর্মের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা পাবে, দুর্নীতি হ্রাস হবে এবং সুশাসন অর্জিত হবে। প্রথম দুটি আইন ও এই শেষের আইন, তাদের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একদিকে খবর খুঁজতে গেলে ফাঁসির হুমকি, অন্যদিকে জবাবদিহির বিষয়ে উৎসাহ দিতে তথ্যের অধিকারের প্রতিশ্রুতি—এই দুটো তো একসঙ্গে চলতে পারে না।
২০০৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে স্পষ্ট জানায়, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এই জাতীয় সরকারি গোপনীয়তা আইন চালু থাকতে পারে না, এটা গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই কমিশনের প্রধান ভিরাপ্পা ময়লি আইনটি অবিলম্বে বাতিলের সুপারিশ করেছিলেন।
যে সরকারি গোপনীয়তা আইন ব্যবহার করে রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেটি গৃহীত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, ১৯২৩ সালে। তখন ভারতজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে, গান্ধীজির নেতৃত্বে রাস্তায় নেমে এসেছে হিন্দু-মুসলমান সব ধরনের মানুষ। এই আন্দোলন ঠেকাতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত হলো সরকারি গোপনীয়তা আইন। এই আইনের অধীনে গুপ্তচরবৃত্তি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হয় এমন যেকোনো কার্যকলাপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনি ভাষায় এখানে প্রতিটি অপরাধ এমন সুবিস্তৃত ও অনির্দিস্ট ভাষায় লিখিত যে ব্রিটিশ সরকারের কাছে না-পছন্দ এমন যেকোনো কাজকেই এই আইনে মামলা ঠুকে দেওয়া যেত। ব্রিটিশ আমলের এই স্বাধীনতা আন্দোলনবিরোধী আইনকেই বাংলাদেশ কার্যত অপরিবর্তিত অবস্থায় গ্রহণ করে। দাঁড়ি-কমা বদল হয়েছে বটে, কিন্তু মোদ্দা কথায় কোনো ফারাক নেই। আইনের মূল ইংরেজি পাঠ দেখুন এইখানে: https://bit. ly/3 u7 qwJY)
শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই ব্রিটিশ মডেলের গোপনীয়তা আইন চালু রয়েছে। যেমন প্রতিবেশী ভারতে। অল্পবিস্তর সংশোধনী যুক্ত হলেও সেখানে আইনটি মোটামুটি সেই মান্ধাতার আমলে চালু ব্রিটিশ কালাকানুন। এই আইনের বিরুদ্ধে ভারতে বিস্তর তর্কবিতর্ক হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, আইনটি বাতিল হওয়া উচিত। ২০০৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে স্পষ্ট জানায়, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এই জাতীয় সরকারি গোপনীয়তা আইন চালু থাকতে পারে না, এটা গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই কমিশনের প্রধান ভিরাপ্পা ময়লি আইনটি অবিলম্বে বাতিলের সুপারিশ করেছিলেন।
বাংলাদেশেও আমাদের এই জাতীয় গোপনীয়তা আইন বাতিলের কথা ভাবতে হবে।ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে যে আইন চালু হয়েছে, সেটি বাতিলের দাবি অনেক আগে থেকেই উঠেছে। সরকার আইনটি পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত আইনটি চালু রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাবে, বাংলাদেশে এই ডিজিটাল আইনের অধীনে প্রায় ৯০০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাময়িকভাবে আটক করা হয়েছে ৩৫০ জনের বেশি। দেশের একাধিক শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক এই আইনের অধীনে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, সরকার চাইলে ডিজিটাল আইন ও গোপনীয়তা আইন উভয় অস্ত্র ব্যবহার করেই তথ্যপ্রবাহে বাধা দিতে পারেন।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা একটি বিপজ্জনক পেশা, এটা কোনো অজ্ঞাত তথ্য নয়। কিন্তু নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক আসামি হবেন, রোজিনা কখনোই সেকথা ভাবেননি। সাংবাদিকের একটা কাজ হলো ক্ষমতাধরদের তাঁদের কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। এই জবাবদিহি তখনই সম্ভব, যখন তাঁদের কথায় ও কাজে ফারাক কোথায়, তা ধরিয়ে দেওয়া হয়। রোজিনা ঠিক এ কাজটিই করেছেন। চোর, তা সে মধ্যরাতের নিশিকুটুম্ব হোক অথবা সচিবালয়ের কর্তাব্যক্তি—নিজের অপরাধ ঢাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। একজন সাংবাদিক চাইলে শুধু একজন স্টেনোগ্রাফার হয়ে কর্তাব্যক্তিরা কী বললেন, তা অবিকল উদ্ধৃত করে নিজের দায়িত্ব সারতে পারেন। অথবা তিনি রোজিনার মতো খবরের পেছনে খবর—আলোর নিচে অন্ধকার—খুঁজে আনতে পারেন। নিজের কোনো ফায়দা হবে, সেকথা ভেবে তিনি করেন না। সত্য উদ্ধার তাঁর পেশাদারি দায়িত্ব, সে কারণেই করেন।
সত্য প্রকাশের জন্য যদি কাউকে জেলে যেতে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে তার চেয়ে বেদনার ঘটনা আর থাকবে না।
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক