তাঁর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক আমি অনেক বছর ধরে। পরিশ্রম করে জোগাড় করা তথ্য এবং অকাট্য যুক্তিনির্ভর তাঁর প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ লাখ লাখ পাঠকের মতো আমাকেও সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে নতুন করে ভাবার তাগিদ জোগাত। ছাত্রজীবন থেকেই আইনের শাসন, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ও মানবাধিকার বিষয়ে আগ্রহ থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মিজানুর রহমান খানের লেখার ভান্ডারের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তাঁর লেখাগুলো গতানুগতিক উপসম্পাদকীয় ছিল না; সেগুলো একজন বিবেকবান সক্রিয় নাগরিককে ভিন্ন চিন্তনের প্রেক্ষিত জোগাত।
বন্ধু শাহদীন মালিক ও আসিফ নজরুলের সঙ্গে আলাপে ও আড্ডায় আইন, সংবিধান ও মানবাধিকার বিষয়ে সাংবাদিকতার জগতে মিজানুর রহমান খান যে দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, তা জানতে পেরেছিলাম। আর এসব কারণেই তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য উদ্গ্রীব ছিলাম। অল্প দিনের মধ্যে সে সুযোগ ঘটল। আমাদের পরিচয়পর্বের কিছুদিনের মধ্যেই ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের চতুর্থ সপ্তাহে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল নামে। এ বিষয়ে মিজান এবং আমার আগ্রহ দুজনের যোগাযোগের মাত্রা বাড়ায়। দ্রুত বহমান এই ঘটনার বিষয়ে দেশি-বিদেশি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও তার ব্যাখ্যা নিয়ে টেলিফোনে প্রায়ই দীর্ঘ আলাপ হতো। বলা বাহুল্য, সেই সঙ্গে বন্ধুত্বও গাঢ় হতে শুরু করে।
২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যার ওপর আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের দ্বিতীয় শুনানির বিষয়টি আমি মিজানকে জানালে তিনি ভীষণ উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। আমরা দুজনেই একমত হই দেশের শীর্ষ দৈনিকে এ বিষয় নিয়ে যদি প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়, তবে এ দেশে থাকা এবং দেশের বাইরে থাকা অগণিত বাংলাভাষী রোহিঙ্গা গণহত্যার স্বরূপ এবং তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবেন। এতে শরণার্থীদের সম্পর্কে সহমর্মিতা সৃষ্টি হবে এবং একই সঙ্গে রোহিঙ্গা নিধনের জন্য সুদূরপ্রসারী যে পরিকল্পনা বর্মি রাষ্ট্র গ্রহণ করেছিল, সে সম্পর্কে পাঠকেরা অবহিত হবে।
ট্রাইব্যুনাল উদ্যোক্তাদের প্রথম আলো ও মিজানের আগ্রহের কথা জানালাম। তারা সাগ্রহে অতি দ্রুত আমন্ত্রণ পাঠাল। পরিকল্পনা ছিল দুজনে একই ফ্লাইটে যাব, কিন্তু মিজানের ভিসা প্রাপ্তিতে দেরি হওয়ায় তিনি সারা রাত যাত্রা শেষে সকালবেলায় এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি ট্রাইব্যুনাল ভেন্যুতে উপস্থিত হলেন। তিন দিন ধরে একটানা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছেন। যেখানে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনগুলোয় আমাদের সরকারি প্রতিনিধিদের খণ্ডকালীন উপস্থিতি ছিল, তার বিপরীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গভীর মনোনিবেশ করে রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং মিয়ানমারের অন্যান্য নির্যাতিত নৃগোষ্ঠীর সাক্ষীদের বক্তব্য, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য এবং বিচারকদের মতামত তিনি আগ্রহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন।
অধিবেশনের বিরতির সময় আমরা যখন রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা নেতৃবৃন্দ এবং বর্মি ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বা আড্ডায় ব্যস্ত, তখন মিজানকে দেখেছি গণহত্যার কোনো উত্তরজীবী (সারভাইভার), গণহত্যা অথবা আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ে কোনো বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। এক সন্ধ্যায় হোটেল লবিতে রাত ১১টা পর্যন্ত তাঁকে তেমনই এক সাক্ষাৎকার নিতে দেখেছিলাম। পরদিন ব্রেকফাস্টের সময় যখন জিজ্ঞাসা করলাম, রিপোর্ট কখন পাঠাবেন? আমাকে অবাক করে দিয়ে মিজান জানালেন, রাত তিনটার দিকে তিনি তা ফাইল করে দিয়েছেন। ওই কয়েকটা দিনেই কাজের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার, পরিশ্রম করার অপার শক্তি এবং ঘটনার পেছনে প্রবাহগুলোকে জানতে চেষ্টা করার অদম্য আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছিলাম।
সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকা মিজানের কুয়ালালামপুর শহরের বিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ না দেখায় আমি ধরেই নিয়েছিলাম তিনি আগেও সেখানে গেছেন। জিজ্ঞাসা করায় জানালেন, না, এই তাঁর প্রথম সফর। একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘শহরটা একটু দেখবেন না?’ প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘বেঁচে থাকলে আবার আসার সুযোগ তো হবে, তখন দেখে নেব।’ যোগ দিলেন, ‘একসঙ্গে এত বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদ আর রোহিঙ্গা নেতারা রয়েছেন, তাঁদের বক্তব্যগুলো নেওয়া তো জরুরি। তা-ই নাহয় করি।’ বুঝলাম, কাজপাগলা আমার নতুন বন্ধুটি কাজের নেশায় বুঁদ। কথা বাড়ালাম না।
আমার দেশে ফিরে আসার আগের সন্ধ্যায় তাঁর কাজের চাপ কম থাকায় লম্বা আড্ডা দিলাম। প্রসঙ্গক্রমে আমার গ্রাম গোপালগঞ্জ জেলায় জানতে পেরে তিনি প্রায় বাকরুদ্ধ। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে জানতে চাইলাম, কেন তিনি অবাক হলেন। হা হা করে হেসে বললেন, ‘অফিসে আমরা কয়েকজন ধরেই নিয়েছি আপনার পরিবারের সঙ্গে উর্দুভাষীদের যোগসূত্র রয়েছে।’ ব্যাখ্যা করলেন, ক্যাম্পের উর্দুভাষীদের অধিকার বিষয়ে আমার উৎসাহ এবং তাদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে আমার সক্রিয়তা, সেই সঙ্গে কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী আবরার নাম ও চেহারার আদলের কারণেই তাঁদের এ ধারণা। হোটেল কাঁপানো হাসিতে দুজন ফেটে পড়েছিলাম।
আলাপের মধ্যে এল একজন বিদেশি কূটনৈতিকের বাসায় নিমন্ত্রণে গিয়ে তাঁর বিড়ম্বনা পরিস্থিতিতে পড়ার বিষয়। ‘দাওয়াত তো খেলাম। সমস্যায় পড়লাম যখন হোস্ট আমার আপত্তি সত্ত্বেও গাড়িতে একটি প্যাকেট তুলে দিল।’ নিজেকেই তখন প্রশ্ন করলাম, একই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে এই উপঢৌকন প্রাপ্তি আমার কোনো সহকর্মী কিংবা সাংবাদিক এমন বিবেকের যন্ত্রণায় কি ভুগতেন, যেমন ভুগেছিলেন ন্যায়বান মিজানুর রহমান খান?
মাস তিনেক আগে এক যুগ ধরে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে যাওয়া শিপু কিছুটা ঠাট্টাচ্ছলেই বলেছিল, ‘খালাম্মার (আমার স্ত্রী তাসনিম সিদ্দিকী) তো দু-দুটো লম্বা সাক্ষাৎকার ছাপা হলো প্রথম আলোতে, তাও দু-তিন বছরে। আপনার একটাও তো দেখলাম না।’ তার ঠাট্টার পালে বেশি হাওয়া জোটেনি। কাকতালীয়ভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মিজান একদিন ফোনে জানালেন, শ্রম অভিবাসীদের নিয়ে আমার একটা সাক্ষাৎকার প্রথম আলো ছাপবে। দেওয়া হলো সাক্ষাৎকার। আবার ফোন মিজানের, ছবি লাগবে। নিরুপায় হয়ে তাসনিমকে বললাম সেলফোনে তুলে দিতে। স্ত্রী ফটোগ্রাফার হলে স্বামীর কি যন্ত্রণা পোহাতে হয়, সেদিন টের পেয়েছি। ভ্রু ঠিক করা নিয়ে অনেক ঝগড়াঝাঁটির পর মোটামুটি জুতসই ছবি পাঠালাম। ‘রাজকীয় ছবি হয়েছে’, ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলেন মিজান। জানালাম, তাঁকে পাঠানো ছবি আমার স্ত্রীর তোলা। তিনি ফোনটা তাসনিমকে দিতে বললেন। তাঁকে জানালেন, ‘প্রথম আলো আপনার এই প্রয়াসকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবে।’ বিষয়টি নিয়ে পরেও হাসাহাসি করেছি আমরা। প্রাণখোলা এমন হাসি বিশুদ্ধ মনের মানুষেরই সহজাত।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে রোহিঙ্গাবিষয়ক গণহত্যা ও আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি দল বাংলাদেশে আসে। কক্সবাজার থেকে ফিরে এসে আমার বাসায় রাতের খাবারের আয়োজন নির্দিষ্ট করা ছিল। বিধি বাম। বেশ কয়েক ঘণ্টা বিমান দেরিতে আসার কারণে ওই টিমের সঙ্গে প্রথম আলো আয়োজিত মিজানের যৌথ আলোচনা পিছিয়ে যায়। ট্রাফিক জ্যামের এই নগরীতে সোনারগাঁও হোটেল থেকে বনানীতে এসে নিমন্ত্রণ রক্ষা অতিথিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমার পার্টি ভেস্তে গেলে। মিজান ছিলেন নির্লিপ্ত, যেন কিছুই হয়নি। রাগ হয়েছিল খুব তাঁর ওপর। ওই আলোচনায় আমিও ছিলাম। চলেছিল রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত। পরে ধারাবাহিকভাবে প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল ওই সন্ধ্যায় আলোচনার ওপর ধারণ করা প্রতিবেদন। লজ্জা পেলাম নিজেরই কাছে। কত বড় একটা কাজ হলো, কত লোক আবার নতুন করে জানবে রোহিঙ্গা সম্পর্কে বিশ্বের ভাবনা। কাজকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করা মিজানের কাছে একটা দাওয়াত তো তুচ্ছই বিবেচিত হবে। এতে অবাক হওয়ারই-বা কী আছে।
রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার মিজানুর রহমান খানের বিশেষ ভাবাবেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ নিয়ে নানা প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার তিনি প্রথম আলোয় লাগাতারভাবে লিখেছেন, প্রকাশ করেছেন। ফলে, বিশ্ব রোহিঙ্গা অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তো তাঁর প্রয়াণে বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনবিদ জন প্যাকার লিখেছেন, তাঁর মৃত্যু সাংবাদিকতা পেশার জন্য বিরাট ক্ষতি। গণহত্যাবিষয়ক খ্যাতিমান গবেষক গ্রেগরি স্ট্যানটন শোকবিহ্বল ভাষায় জানালেন, এমন তো হওয়ার ছিল না। আমার ও মিজানের পরম বন্ধু বর্মি ভিন্নমতাবলম্বী রোহিঙ্গা গণহত্যা বিশেষজ্ঞ মং জার্নি জানালেন, তাঁর মৃত্যুতে রোহিঙ্গারা তাদের এক অকৃত্রিম বন্ধুকে হারাল। মিজান চলে যাওয়ার এক দিন পর রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির থেকে একজন তরুণ আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্যার, আমাদের কথা এমন জোরালোভাবে আর কে লিখবে?’ জবাব দিতে পারিনি সে প্রশ্নের।
অক্টোবরের শেষের দিকে টেলিফোনে কুশলবিনিময়ের সময় মিজান জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোনো বিষয় নিয়ে বিচলিত কি না। হয়তো আমার কণ্ঠস্বরে তাঁর তা মনে হয়েছিল। জানিয়েছিলাম, কিছুটা ঝামেলায় আছি। বিজয়নগরে ১৯৫০ সাল থেকে আমাদের পারিবারিক মালিকানায় এবং দখলে থাকা এজমালি রাস্তার একাংশ আমার চাচাতো ভাইয়ের কাছে থেকে কেনা প্লটের নতুন মালিক পুরোনো সীমানা নির্ধারণকারী দেয়াল ভেঙে দখল করে নির্মাণকাজ শুরু করেছেন। তিনি জানতে চাওয়ায় বললাম, দখলদার একজন প্রভাবশালী সাংসদ ও মন্ত্রী। মিজান জানালেন, এ নিয়ে সংবাদ করার মতো কোর্ট-কাছারি হলে কাগজপত্র পাঠালে প্রয়োজনে তিনি নিজে ‘ঝাঁপিয়ে’ পড়বেন।
সত্যি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো মানুষই ছিলেন মিজান। সে অন্যায় গণহত্যার মতো রাষ্ট্রীয় অপরাধীই হোক, সে অন্যায় ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য দায়ী বা প্রথম আলোর সম্পাদক তাঁর প্রিয় মতি ভাইকে উৎপীড়নকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই হোক বা আমার মতো সাধারণ নাগরিকের সম্পত্তি আত্মসাৎকারী প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হোক। বড় অকালে চলে গেলেন নতুন বন্ধু আমার।
সি আর আবরার অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক।