জার্মানির অভিবাসননীতি নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মতো যুক্তরাজ্যও নাখোশ। দেশটির মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষে জনমত সক্রিয় রয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এই জনমতের বিষয়টি আমলে নেন এবং আগামী ২৩ জুন গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে (ইইউ) ব্রিটিশ সদস্যপদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
ব্রিটেন ১৯৭৩ সালে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। লক্ষ্য ছিল সুলভ মূল্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য ও অভিন্ন বাজারসুবিধা। ১৯৯৩ সালে তা হয়ে যায় ইইউ, নিজস্ব মুদ্রা, নীতিমালা, নাগরিকদের জন্য সীমানামুক্ত বিচরণসহ যুক্ত হয় অনেক পরিবর্তন। অনেক দিন ধরেই ব্রিটেনের ইইউর বিধিনিষেধ মেনে চলা নিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকেরা নাখোশ। এই গণভোটের ঘোষণা হতে পারে কেবলই ইইউকে চাপের মুখে ফেলে দাবি আদায়ের কৌশল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সদস্য রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ব্রাসেলসে দুই দিনের আলোচনার পর ক্যামেরন ইইউর নীতিগত কিছু পরিবর্তনের বিনিময়ে সদস্যপদ পুনর্বিবেচনা জনগণের হাতে ছেড়ে দেন। ইইউর যেসব পরিবর্তনে তিনি রাজি হন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে শিশুসহ অভিবাসীদের যুক্তরাজ্যে সামাজিক সুরক্ষা ভাতার বিষয় পুনর্নির্ধারণ, ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের ব্যবহার, নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক নীতি ইইউর বিধিনিষেধমুক্ত রাখা (বিবিসি নিউজ)।
গণভোটের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই জনগণ ইইউ সদস্যপদের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি দলে ভাগ হয়ে যে যার সপক্ষে জোর যুক্তি তুলে ধরছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে একে বলা হচ্ছে ব্রেক্সিট, অর্থাৎ ব্রিটেনের এক্সিট। অনেকেই মনে করে ব্রিটেনের ইইউ ছেড়ে দেওয়া হবে মারাত্মক ভুল। এই সদস্যপদের কারণে ব্রিটিশ নাগরিকেরা ইইউভুক্ত দেশগুলোতে কম খরচে ও অবাধ ভ্রমণের সুবিধা, দুর্ঘটনায় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা, মানবাধিকার সুবিধা, ইইউ সদস্যদেশগুলোতে কাজের সুবিধা ও অবসরের পরও কর্মী হিসেবে অধিকার সংরক্ষণ, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গোপন তথ্যসেবা, শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পেয়ে থাকে। ফলে ইইউ ছাড়লে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হবে দেশের জিডিপির ২-৯ শতাংশ, বাণিজ্য ঘাটতি হবে, অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, প্রতিটি দেশের সঙ্গে ব্যবসার ক্ষেত্রে আলাদা করে চুক্তি করতে হবে। অনেকে মনে করে এতে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় একদিকে রাশিয়া, অন্যদিকে জঙ্গিবাদের উত্থান ও আক্রমণের প্রেক্ষাপটে ইইউ সদস্য হিসেবে ব্রিটেন নিরাপত্তার দিক থেকে শক্তিশালী, কারণ ইইউ সদস্যরাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থে একজোট হয়ে কাজ করে।
যারা ইইউ সদস্যপদ ত্যাগের পক্ষে, তারা মনে করে ইইউ ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অনেক বেশি হস্তক্ষেপ করে। ইইউ ছাড়লে ব্রিটেন স্বাধীনভাবে নিজেদের শাসনে চলতে পারবে। ইইউ অভিবাসননীতির কারণে অদক্ষ মানুষ কম বেতনে কাজ করছে, ফলে ব্রিটিশ জনগণ কাজ পাচ্ছে না এবং কাজের মান নষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া এই সদস্যপদের জন্য ব্রিটেনকে বছর বছর বিপুল অর্থ গুনতে হয়। ২০১৫ সালে ইইউ বাজেটে ব্রিটেনকে দিতে হয়েছে ১৩ বিলিয়ন পাউন্ড। অনেকের মতে, এই অর্থ নিজ দেশ ও মানুষের কল্যাণে খরচ করা সম্ভব। যারা ব্রেক্সিটের পক্ষে, তারা মনে করে না ইইউ বলয়ের বাইরে গেলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো হুমকি দেখা দেবে, কারণ ব্রিটেন জাতিসংঘের সদস্য। ন্যাটো জোটভুক্ত হওয়ার কারণে নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ইউরোপীয় দেশগুলো ব্রিটেনকে সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ফ্রি-ট্রেড ও জি-৭–এর সদস্য হওয়ায় মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা পাবে। এ ছাড়া ইউরোপে অর্থনীতির মন্দার কারণে ইউরোর মূল্য কমে যাচ্ছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে ব্রিটেনের ইউরোপ থেকে খুব লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদের মতে, গণভোটের ঘোষণার কারণে এখনই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। ব্রেক্সিটের ফলে এখনকার প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য সম্পর্কোচ্ছেদের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষতি দেখা দেবে (দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা)। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন নিজেও ইইউর সদস্যপদ সংরক্ষণের জন্য জনগণকে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিতে আহ্বান করছেন। অপর দিকে লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন ‘না’ ভোটের পক্ষে আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই গণভোট একটি সুবর্ণ সুযোগ, আসল পরিবর্তন আনার। ‘না’ ভোটের সমর্থকেরা মনে করে, ব্রিটেন সুইস বা নরওয়ের মডেল অনুসরণ করতে পারে, যেখানে ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক এরিয়ায় যুক্ত হয়ে অভিন্ন বাজারসুবিধা ভোগ করতে পারে।
ব্রিটিশ নাগরিকেরা যখন ইইউতে থাকা না-থাকার সুবিধা-অসুবিধাগুলো হিসাব করছে, তখন এটা সম্ভবত তাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে যে সব প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এখানে অনেক রাজনৈতিক ও মূল্যবোধ মূল্যায়নের অবকাশও আছে। ব্রিটেন কী পরিমাণ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে, কত ব্রিটিশ নাগরিক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ বা থাকার সুবিধা পাচ্ছে, তাতে তাদের জীবনমানের কী পরিবর্তন আসছে, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ে কী পরিমাণ সুবিধা পাচ্ছে, প্রতিটি দেশের সঙ্গে আলাদা করে বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তি করতে গেলে যে পরিমাণ লোকবল ও তৎসংশ্লিষ্ট খরচ বেড়ে যাবে এবং যারা কর্মচ্যুত হবে বা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাদের চাপ কীভাবে সামাল দেবে, সেই সবও আমলে রাখা দরকার।
তা ছাড়া ‘না’ ভোটের পক্ষে যেসব কারণ বলা হচ্ছে, তার অধিকাংশই ইইউ পূরণ করেছে এবং ব্রিটেনকে ইইউতে ‘বিশেষ অবস্থান’ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। আমার এক জার্মান বন্ধু একবার জানিয়েছিল, স্কুলে ইতিহাস পড়ানোর সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কীভাবে জার্মানির আগ্রাসী ভূমিকার কারণে বিশ্বযুদ্ধ বেধেছিল তা পড়ানো হয়, যাতে তারা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং জাতি হিসেবে গর্বে অন্ধ হয়ে না পড়ে। যারা ইইউ ত্যাগ করার কথা বলছেন, তারা জনগণের মধ্যকার জাতীয়তাবোধকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দুঃখজনকভাবে আমরা দেখছি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন শক্তিশালী জাতীয়তাবোধের পুনর্জাগরণ ঘটছে। তবে ইতিহাস বারবার আমাদের শিক্ষা দিয়েছে তীব্র জাতীয়তাবাদের পরিণতি কতটা নেতিবাচক হতে পারে। ব্রিটিশ জনগণ এ বিষয়টিকে বিবেচনায় নেয় কি না তা ২৩ জুনের নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে।
বিশ্বে এখন নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা দিনে দিনে বাড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময়ে এই প্রথম ইউরোপ সবচেয়ে অনিরাপদ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া, চীন, ইরান ও সৌদি আরবের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্বাসহীনতার সম্পর্ক দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রসারে ব্রিটিশ নাগরিকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। এমন বিভিন্ন জানা-অজানা দেশবিহীন শত্রু থেকে জানা-অজানা হুমকির মুখে একজোট না হয়ে জোটছিন্ন হওয়া সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধাজনক হবে বলে মনে হয় না।
আইরীন খান: সমাজকর্মী ও গবেষক।