বিপর্যস্ত যোগাযোগ: শক্তিক্ষয় মানুষের
লোকজন নানা জায়গায় প্রতিবাদে সড়কে ধানের চারা পর্যন্ত লাগিয়েছেন; এখন তারও উপায় নেই, ডুবন্ত সড়কে সাঁতার কাটা ছাড়া। কয়েক বছরের অতিবৃষ্টিতে দেশের সড়ক যেন আর সড়ক নেই। যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ের সড়ক একসময় দেশের সবচেয়ে মসৃণ সড়ক ছিল। এখন সেখানেও খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। তার সঙ্গে দুটি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২০-২৫ মিনিটের রাস্তা পার হতে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে। অথচ একসময় ঈদযাত্রায়ও সেখানে যানজট হতো না। এই পরিস্থিতিতে আমরা আবারও যমুনা সেতু-পূর্ব সময়ে ফিরে গেছি। তখন ফেরি পার হয়ে বগুড়া যেতে ছয়-সাত ঘণ্টা সময় লাগত, এখন যমুনা সেতু দিয়ে বগুড়া যেতে আট-নয় ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। ফলে মানুষের কর্মসময় ও শক্তি নষ্ট হচ্ছে। পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে দেশে নতুন করে বন্যা শুরু হয়েছে, আবার সামনে ঈদ, ফলে তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
দুর্যোগ বা ঈদের সময় সড়কে এমন জট লাগা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এখন স্বাভাবিক সময়েও এমনটা হচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে একটি তথ্য দেওয়া দরকার। সেটা হলো, বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর এই সড়কে প্রতিদিন হাজার তিনেক যানবাহন চলাচল করত। এখন স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ১২ হাজারের ওপরে যানবাহন চলাচল করে। সর্বশেষ গত ঈদে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২৭ হাজার পর্যন্ত যানবাহন চলাচল করেছে। ফলে সহজেই অনুমেয়, যে সড়ক একসময় দিনে সাড়ে তিন হাজার যানবাহনের ভার বহন করত, তার পক্ষে এখন সাড়ে ১২ হাজার যানবাহনের ভার বহন করা কঠিন। তার সঙ্গে গত কয়েক বছরের অতিবৃষ্টিতে সড়কের বিটুমিন আর জমাট বেঁধে থাকতে পারছে না। বিটুমিনের ধর্মই এটা, পানি জমলে সে টিকে থাকবে না।
এই যানবাহন বেড়ে যাওয়াটা আমাদের সামাজিক গতিশীলতার লক্ষণ। এই ১৩-১৪ বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যখন ট্রেনে চেপে বাড়িতে (টাঙ্গাইল) আসতাম, তখন ট্রেন একরকম ফাঁকা থাকত। এমনকি ঈদ বা বড় কোনো ছুটির সময়ও ছাত্ররা ট্রেনের এক আসনে বসে সামনের আসনে পা তুলে দিত। শুধু তা-ই নয়, পায়ের ওপর চাদর বিছিয়ে তাস পেটাত। এর জন্য যে অন্য যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, তা নয়। অর্থাৎ তখন এত যাত্রী হতো না। মনে আছে, যখন সরাসরি ঢাকা-রাজশাহী ট্রেন চালু হলো, তখন পাবনার কোনো এক স্টেশনে মানুষকে বলতে শুনেছি, এখন আমরা সরাসরি ট্রেনে ঢাকা যেতে পারি, এ অনেক বড় সৌভাগ্য! অর্থাৎ তখন উত্তরবঙ্গের খুব বেশি মানুষ ঢাকা আসতেন না। এখন আসছেন। অভ্যন্তরীণ অভিবাসন মানুষের উন্নতির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। কিন্তু সমস্যা হলো, এই অভিবাসীদের গন্তব্য প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে ঢাকা। দেহের সব রক্ত যেমন মুখে এসে জমা হওয়া স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, তেমনি দেশের সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়াটাও অর্থনীতির স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
পরিকল্পনা করার সময় আমরা খুব বেশি দূর দেখতে পাই না। পরিকল্পনাকারীদের ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা আছে। যমুনা সেতু চালুর সময়ই তাঁরা যদি আজকের অবস্থা কল্পনা করতে পারতেন, তাহলে আজ এ রকম লেজে-গোবরে অবস্থা হতো না। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এখন চার লেনের কাজ চলছে। অথচ এটা তো যমুনা সেতু নির্মাণের সময়ই করা উচিত ছিল। অবশ্য কাজ একবারে না করে বারবার করলে ঠিকাদারসহ রাজনৈতিক নেতাদের লাভই হয়! আবার ১০ বছর পর হয়তো দেখা যাবে, এটাও যথেষ্ট নয়।
যাহোক, দেশে একধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। মানুষ অবস্থার উন্নতির জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। এই শক্তি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে সড়কে যেমন যানের গতি বাড়াতে হবে, তেমনি সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশে প্রচুর খাল-বিল আছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকলেও বর্ষাকালে তো এসবে পানি থাকে। তাহলে তখন আমরা নৌপথ ব্যবহার করি না কেন? আঞ্চলিক যোগাযোগের জন্যও কেন মহাসড়ক ব্যবহার করতে হবে? অন্যদিকে রেল যোগাযোগ উন্নত করতে হবে। যোগাযোগের গতি বাড়াতে না পারলে মানুষের শক্তিক্ষয়ই হবে, সেই শক্তি পুরোপুরি কাজে লাগানো যাবে না, এটা মাথায় রাখা দরকার।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক।