দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার যে সংকটের মধ্যে পড়েছিল, সেখান থেকে উত্তরণের পর অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন যে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আরও গতি পাবে। কিন্তু গতি পাওয়া দূরের কথা, বরং বিচার-প্রক্রিয়াটি আরও শ্লথ হয়ে গেল। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ৫৪ দিন ধরে চেয়ারম্যানের পদটি খালি পড়ে
ছিল। এত এত নেতিবাচক খবরের সঙ্গে কিছুদিন আগে আবার যুক্ত হলো রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বিরোধ!
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, সেই ভয়ংকর সন্ত্রাসের মধ্যেও একাত্তরের হন্তারক কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার সাহসের পরিচয় দিয়েছিল। ওই মৃত্যুদণ্ডের বাস্তবায়নে ইতিহাসের দায় যেমন মিটেছিল, তেমনি তা ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী ১৬ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষাও পূরণ করেছিল। কিন্তু তারপর তিনটি মাস গড়িয়ে স্বাধীনতার মাস অতিক্রম করছি আমরা। এ মাসেও আমরা কোনো রায় পাচ্ছি না।
দুই.
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন অনুযায়ী দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা এ পর্যন্ত নয়টি মামলায় রায় প্রদান করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা এক মিনিটে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুটি ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন জামায়াতের সাবেক নেতা আবুল কালাম আযাদ, জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে । ট্রাইবুন্যাল দুটি ৯০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেছেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেছেন বিএনপির নেতা আবদুল আলীমকে।
সাতজনের মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রয়েছে। এ মামলাগুলো হচ্ছে গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আবদুল আলীমের মামলা। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় যুক্তিতর্ক চলছে, আগামী মাসে মামলার রায় হবে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিচার চলছে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মোবারক হোসেন ও জামায়াতের এ টি এম আজহারুল ইসলামের। জামায়াতের আরেক নেতা এ কে এম ইউসুফ ১৫ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁর মামলার সমাপ্তি টেনেছেন।
তিন.
বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের ৩৮ বছর পর ১৯৭১ সালের এদেশীয় ঘাতক ও হস্তারকদের বিচার শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে। দুই বছর নয় মাস ধরে চলা এ বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে যেমন কিছু অনন্য অর্জন করেছে, তেমনি তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধাপরাধ, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
প্রথমত, একাত্তর সালে সংঘটিত গণহত্যা, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করতে না পারা, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের বিচারের ব্যাপারে দায়মুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেই জায়গা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও জাতিগত ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে।
দ্বিতীয়ত, এ বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইতিহাসের দায় থেকে মুক্ত হলো, কেননা এর মাধ্যমে একাত্তরের ঘাতক ও হন্তারকদের প্রধান কুশীলবেরা যেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে, অন্যদিকে এর মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়।
তৃতীয়ত, ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল, ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফার ইস্ট বা টোকিও ট্রাইব্যুনাল ছিল যুদ্ধাপরাধ, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। কম্বোডিয়ায় গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য সে দেশের বিদ্যমান বিচারিক কাঠামোর মধ্যে যে ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি চেম্বারস ইন দ্য কোর্টস অব কম্বোডিয়া’ গঠিত হয়েছিল, সেটি ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মিশ্র আদালত। উল্লিখিত প্রতিটি আদালতে বিচারক, আইনজীবী ও প্রসিকিউটর হিসেবে দেশি-বিদেশি বিচারক ও আইনজীবীরা কাজ করেন, কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাঁরা বিচারক, আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন, তাঁরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছে এ অর্থে যে বাংলাদেশে স্থাপিত ও প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সর্বজনীন এখতিয়ার প্রয়োগ করে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ও টোকিও ট্রাইব্যুনাল চার্টারের অনুসরণে প্রণীত ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন অনুযায়ী বিচার করে নয়টি মামলায় ১০ ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করেছেন।
চতুর্থত, শান্তি ও অহিংস আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন, ‘আমি যখন হতাশ হয়ে যাই তখন আমি মনে রাখি যে ইতিহাসে সব সময় সত্য ও ভালোবাসার পথই জয়যুক্ত হয়েছে। মানুষের সমাজে স্বৈরাচারী ও হত্যাকারীরা আসে এবং কিছু সময়ের জন্য তাদের অপ্রতিরোধ্য মনে হয়, কিন্তু পরিশেষে তাদের সবারই পতন হয়।’ মহাত্মা গান্ধীর এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। কেননা, দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে মনে হয়েছিল, একাত্তরের ঘাতক ও হন্তারকেরা বোধ হয় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মাধ্যমে একাত্তরের এদেশীয় ঘাতক ও হন্তারকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এখন শুধু রায় কার্যকর করা বাকি।
চার.
চলমান মানবতাবিরোধী বিচারে উল্লেখযোগ্য অর্জন সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কিছু মৌলিক ঘাটতির জায়গাও রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি শক্তিশালী গবেষণা সেল, একটি মিডিয়া সেল, একটি আইটি সেল এবং একটি আন্তর্জাতিক সেল থাকা দরকার ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও যুদ্ধাপরাধবিষয়ক গবেষকদের দ্বারা গঠিত গবেষণা সেল ট্রাইব্যুনাল ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারত, যাতে করে কাদের মোল্লার রায়ে ট্রাইব্যুনাল যে ভুল করেছিল, তা এড়ানো যেত। মিডিয়া সেল থাকলে গণমাধ্যমে পরস্পরবিরোধী সংবাদ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশনও এড়ানো যেত। আইটি সেল থাকলে ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে তথ্য চুরি হওয়া রোধ করা যেত। কেননা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায়ের ‘সফট কপি’ কম্পিউটার থেকে চুরি হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক সেল বাংলাদেশে আসা আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার কর্মকর্তাদের এবং বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের চলমান মানবাধিকারবিরোধী বিচার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারতেন। এই সেলের সদস্যরা একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরাজমান নানা বিভ্রান্তি নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতেন। উল্লিখিত বিষয়গুলোকে নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি। অপেক্ষমাণ আপিলগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় কার্যকর করে ইতিহাসের দায়মোচন করাটাও ন্যায়বিচারের দাবি।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।