২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাসন্তীর কলাবাগান কেটে কী পেল বনবিভাগ

বন বিভাগ মধুপুরে বাসন্তী রেমাসহ আরও অনেকের ফলবান গাছ কেটে দিয়েছে।ছবি: প্রথম আলো

মধুপুর টাঙ্গাইল থেকে বিশিষ্ট আলোকচিত্রী টনি সাংমার একটা ছবি ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরের একটু আগেই এক বন্ধুর হাত ঘুরে চলে আসে। প্রথমে ভেবেছিলাম খেতে ফুলকপির চারা লাগিয়ে কলার পাতা দিয়ে ঢেকে রাখার ছবি। ভাবতে পারিনি বাসন্তী রেমার পুরো কলাবাগান নিমেষে কুচলে দিয়েছেন আমাদের রাজকর্মচারীরা। ৪০ শতাংশ জমিতে লাগানো ৫০০টি কলাগাছের সবই এখন শবদেহ। নিজের লাগানো কলাগাছের কাটা দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বাসন্তী রেমা। ধানখেতে আগুন লাগালে কৃষকের যেমন লাগে, কেটে ফেলা কলাবাগান দেখে বাসন্তী রেমা নামের এই মান্দি নারীরও তেমনই লাগার কথা। যাঁরা চাষ করেন, ফসল তাঁদের কাছে সন্তানের মতো।

বন বিভাগ দাবি করেছে, এসব জমি বন বিভাগের। আদতে এসব জমি ছিল ভাওয়াল রাজ এস্টেটের। ’৪৭-এর দেশভাগের পর বন বিভাগ পরিত্যক্ত ও জমিদারি উচ্ছেদের কারণে খাস হয়ে যাওয়া এসব জমি দেখাশোনার দায়িত্ব পায়। গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের বন বিভাগের বন দখল করেছে বেশ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী, কেউ কেউ সেখানে রিসোর্ট বানিয়েছে। ভাওয়াল এস্টেটের জমি ঢাকার কোনো কোনো আবাসন কোম্পানির দখলেও আছে বলে জনশ্রুতি আছে। সেগুলো উদ্ধারের কোনো পাঁয়তারা কখনো দেখা যায় না। শুধু নির্যাতন চলে বিভাগ-পূর্বকাল থেকে বংশ পরম্পরায় স্বদখলীয় জমিতে করে কর্মে খাওয়া মানুষের ওপরে।

গাছ কেটে ফেলার প্রতিবাদে প্রতিবাদলিপি হাতে মান্দি শিশু
ছবি: প্রথম আলো

বাসন্তী রেমার ঘটনা জানার পর স্থানীয় সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুরে কয়েক দিন ধরেই জমি উদ্ধারের নামে স্থানীয় মান্দিদের (গারো) মাঠের ফসল ট্রাক্টর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান চালাচ্ছিল বন বিভাগ। তাদের শখ হয়েছে মধুপুর বনে তারা কাজু চাষ করবে। কাজুবাগান বানাবে। যেমন পাহাড়ের জুমের জমিতে করেছে রাবারবাগান। ২০০৭-০৮ সালের দিকে তাদের হাউস হয়েছিল আগর চাষের। সে সময় নীলকরদের মতো করে জমি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই আগর চাষ আর এগোয়নি-প্রকল্প ব্যর্থ। সে জমি পড়েই ছিল। ব্যর্থ প্রকল্পের জমির সঙ্গে মান্দিদের চাষের জমি যোগ করে বন বিভাগ এখন নতুন করে কাজুবাদাম চাষের প্রকল্প নিয়েছে। এ কারণে চলছে পাকা ধানে মই দেওয়ার জুলুমি কর্মসূচি। ইতিমধ্যেই আরণখোলা ইউনিয়নের আমতলী গ্রামে ১০টি গারো পরিবারের ৫ একর জমির আনারস, পেঁপে, আদা, হলুদ, কলা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

সেই ধারাবাহিকতায় উচ্ছেদ করা হয়েছে বাসন্তী রেমার কলাবাগান। কোনোরকম নোটিস না দিয়েই। করোনা মহামারির সময় যখন খাদ্য ও পুষ্টির প্রশ্নটি বিরাট হয়ে এসেছে, তখন এভাবে ফলের বাগান ধ্বংস করা কি নির্বুদ্ধিতা নাকি ইচ্ছাকৃত নিষ্ঠুরতা? মধুপুর নিবাসী, সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফাদার হোমরিক আজ বেঁচে থাকলে কী হতো জানি না। তিনি সারা জীবন চেষ্টা করেছেন বন আর বনজীবীদের সুরক্ষার জন্য। একবার এক উচ্চপদস্থ বন কর্মকর্তা মধুপুর ভ্রমণে গেলে তিনি বন রক্ষা আর বন সৃজনের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনাদের পদের নামের (কনজারভেটর) মধ্যেই তো গন্ডগোল। বন রক্ষকেরা কী রক্ষা করবে, যদি বন সৃজন না করেন? বন সৃজনের এ কাজটা করেন বনের মাঝে বসবাসকারী মানুষ, পাখি আর প্রাণীরা। তাদের হাতে বনটা ছেড়ে দিলে বন বাড়বে, বন বিকশিত হবে। এদের উচ্ছেদ করলে না থাকবে বন, না থাকবে বাঁশ, না কেউ বাজাবে বাঁশি।’ পদস্থ বন কর্মকর্তা ফাদারের কথার মর্ম না বুঝেই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা বনে বাঁশ লাগাই না।’ সে বহু বছর আগেকার কথা, বনবাবুরা এখনো যে ফাদারের কথার মর্ম বুঝতে পেরেছেন, তার কোনো আলামত নজরে পড়ে না।

গাছ কেটে, চাষের পুকুরে বিষ ঢেলে সব মাছ মেরে ফেলে প্রতিহিংসা মেটানোর খবর তো নিয়মিতই আসে। ফল চাষ, সবজি চাষ, মাছ চাষ করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টাকে রাতের আঁধারে স্তব্ধ করে দেওয়া কি শুধুই হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা, নাকি এক ধরনের মনোবিকার? মনোবিজ্ঞানীরা নিষ্ঠুরতাকে দুভাবে দেখেন—মর্ষকামী ও ধর্ষকামী। প্রথম দলের লোকেরা নিজেরাই নিজেদের কষ্ট দেয়, যন্ত্রণা দেয়, এতেই তাদের পরমানন্দ হয়। এমনও হয়, নিজেকে কষ্ট দিতে দিতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে; তখন কষ্ট দেওয়ার জন্য অন্যের সাহায্য নেয়। যারা আত্মহত্যা করে বা করার ইচ্ছা নিয়ে ঘুরতে থাকে, তারাও এ দলের। আর ধর্ষকামী যারা, তারা আনন্দ পায় অপর কাউকে কষ্ট দিয়ে। মানুষের এ দুটো বৈশিষ্ট্যই মনোরোগের আওতায় পড়ে। ওই দুই শ্রেণির মানুষই পৃথিবীতে অঢেল। আপাতদৃষ্টিতে দেখে কেউই এদের মাঝে কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাবে না। আর দশটি মানুষের মতোই ওদের চলাফেরা-খাওয়া দাওয়া-সামাজিকতা সবই চলে নিখুঁত ধারায়।

ঢাকার ছাদবাগান, ঠাকুরগাঁওয়ের কামিনী কুমার বর্মনের ফলবাগান, নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় তিলনা ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামে আমচাষিদের মিলিত বাগান, মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের কোমরপুর গ্রামের বিধবা রত্না পারভীনের মেহগনিবাগানের চারা গাছ থেকে শুরু করে সাভারের আশুলিয়ায় মাছের খামার, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে খয়েরতলা গ্রামের মাছের পুকুর কিছুই এখন আর এই ধর্ষকামীদের নিষ্ঠুরতার হাত থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিজ প্রাণের ওপর এমন হামলা যে কত বড় নিষ্ঠুরতা, তা কে কাকে বোঝাবে?

এ রোগ এতই ছোঁয়াচে আর মারাত্মক যে দেশ-সমাজ-জাতি ধ্বংসের জন্য আর কোনো অস্ত্র, বোমা বা যুদ্ধের দরকার হবে না। এ রোগের আশু উপশম প্রয়োজন। কিন্তু হাসপাতালে সবাই যখন রোগী, তখন এ কাজ করবে কে?

এত দিন এসব ঘটনা ঘটত রাতের আঁধারে, গোপনে, সাবধানে। এখন দিনদুপুরে প্রকাশ্যে ভিডিও ক্যামেরা খোলা রেখে করা হচ্ছে। আগে মাস্তান ঠ্যাঁটাদের কাজ ছিল এসব। এখন তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি লোকজন প্রকাশ্যে এসব করে ফেলছেন। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালপল্লিতে আগুন দেওয়া থেকে শুরু করে এই ১৪ সেপ্টেম্বর মধুপুরে বাসন্তী রেমার কলাবাগান কচুকাটা করা, সবই ঘটেছে দিনের আলোতে। দিনে দিনে এটাই কি সমাজসিদ্ধ পন্থায় পরিণত হবে?

মানুষ গর্ভবতী প্রাণী মারে না। সরকার চেষ্টা করে ডিমওয়ালা মাছ রক্ষার। ফলবান বৃক্ষ বিক্রি করলেও কাঁচা ফলসমেত গাছ নষ্ট করে না—নদীভাঙনের সময়ও নয়। অক্টোবর/নভেম্বরে যে গাছে কলার কান্দি পড়ত, সে গাছ কেটে ফেলতে যাদের হাত কাঁপে না, তাঁদের হাতে বন নিরাপদ থাকবে?

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।

[email protected]