ফারুক-রশিদের 'পৃষ্ঠপোষকেরা' কোথায়?
১৯৮৯ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় আদালত ফ্রিডম পার্টির ১১ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, এ খবরটি এখন পুরোনো। কিন্তু এই খবরের সঙ্গে আরও যেসব প্রশ্ন জড়িত, সেগুলো মোটেই পুরোনো নয়। প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, গত রোববার ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এবং পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের অস্থায়ী ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির রায় ঘোষণা করেন।
বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলায় প্রত্যেক আসামিকে সাজার অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং হত্যাচেষ্টা মামলায় প্রত্যেককে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন গোলাম সারোয়ার ওরফে মামুন, জজ, ফ্রিডম সোহেল, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ, গাজী ইমাম হোসেন, খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল, মিজানুর রহমান, হুমায়ুন কবির (পলাতক), মো. শাজাহান বালু (পলাতক), লেফটেনেন্ট কর্নেল আবদুর রশিদ (পলাতক), জাফর ও আহম্মদ ওরফে মানিক (পলাতক)। এর মধ্যে লেফটেনেন্ট কর্নেল আবদুর রশিদ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির নেতৃত্বে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। তিনি তখন ওই বাসায়ই থাকতেন এবং ঘটনার সময় ওই বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ওই ঘটনায় বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিত গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করে এবং ‘কর্নেল ফারুক-রশিদ জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ওই মামলায় ১২ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০০৯ সালের ৫ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। আমরা আশা করি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে অপরাধীরা শাস্তি পাবেন।
কিন্তু আদালতের বিচারে যেসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে না, সেগুলো হলো স্বঘোষিত ঘাতকেরা দেশে রাজনৈতিক দল করার সাহস কীভাবে পেল? কে বা কারা তাদের মদদ দিয়েছিল, সেটিও খুঁজে বের করা দরকার।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে প্রায়ই অভিযোগ করা হয়, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিয়েছেন। বিদেশি মিশনে চাকরি দিয়েছেন। তাদের এই অভিযোগ অসত্য নয়। কিন্তু তার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হলো সেই খুনিদের দেশে এনে রাজনৈতিক দল করার সুযোগ করে দেওয়া। মনে রাখা দরকার, ফ্রিডম পার্টি গঠিত হয়েছিল সামরিক শাসক এরশাদের আমলে। জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়ার আমলে নয়। জিয়াউর রহমানের আমলে খুনিদের একাংশ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি নামে একটি দল গঠনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের ঘোষিত নীতি ছিল মুসলিম বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মাঝখানে তারা পুরোনো মুসলিম জাতীয়তাবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চেয়েছিল। পারেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক ও রশিদকে একাধিকবার দেশ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। কিন্তু আশির দশকের শেষার্ধে যখন আওয়ামী লীগ–বিএনপিসহ প্রায় সব দল এরশাদের বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলে, তখনই খুনিরা ফের দেশে এসে ফ্রিডম পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল খাড়া করে। এটি ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব নয়।
১৯৮৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছোড়া হয়, তখন ক্ষমতায় ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরপরও তিনি ১৬ মাস ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু বিচার করেননি। সে সময়ে ফ্রিডম পার্টির নেতাদের সঙ্গে যে তাঁর সদ্ভাব ছিল, তার প্রমাণ ১৯৮৬ সালের কথিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লে. কর্নেল ফারুক রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। যাঁকে খুনের দায়ে কারাগারে পোরার কথা, তাঁকেই এরশাদ সাহেব সসম্মানে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিয়েছেন। এটি করা হয়েছিল প্রধান প্রধান দলের বর্জনের মুখে নিজের রাষ্ট্রপতি পদে নিজের প্রার্থিতা জায়েজ করার জন্য।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করে থাকেন। কিন্তু ১৯৮৬ সালের এরশাদ সাহেবের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেন না। এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি শুধু রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করেননি, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার নামে জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে নানা কুৎসা প্রচার করেছিলেন। তখন যাঁরা এরশাদ সাহেবের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের অনেকে তাঁর সঙ্গে এখনো আছেন। আবার কেউ কেউ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরাও কেউ সেই নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন না।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সেই ফারুকুর রহমানের ফাঁসি হয়েছে। রশিদসহ এখনো পাঁচ খুনি বিদেশে পলাতক; সরকার শত চেষ্টা করেও দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
২৮ বছর পরে হলেও শেখ হাসিনার হত্যাচেষ্টাকারীরা শাস্তি পেয়েছে। এর আগে কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছে বোমা পুঁতে রাখার ঘটনায় ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ সব সন্ত্রাসী ঘটনার বিচার হোক। সেই সঙ্গে সঙ্গে যুগে যুগে যাঁরা ক্ষমতায় থাকার জন্য খুনিদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দেন, নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
শেখ হাসিনার হত্যাচেষ্টার দায়ে ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, যাঁরা ছিল ফারুক–রশিদ প্রতিষ্ঠিত ফ্রিডম পার্টির সদস্য। এ রকম সন্ত্রাসী ঘটনা ফ্রিডম পার্টির ক্যাডারেরা আরও অনেক ঘটিয়েছে। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া প্রয়োজন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পর ফ্রিডম পার্টির প্রকাশ্য তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাদের অপ্রকাশ্য কর্মকাণ্ড থেমে আছে বলা যাবে না।
সুযোগ পেলে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই সমাজে কিংবা রাজনীতিতে লুকিয়ে থাকা ‘ফ্রিডম’ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে সাজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]