ফরিদপুরে ‘আসল’ ও ‘নকল’ আ. লীগ

ফরিদপুর-৪ আসনে দুই নেতার সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে গত ১৭ অক্টোবর ১৪৪ ধারা জারি করে উপজেলা প্রশাসন।
প্রথম আলো

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে এখন সর্বাধিক আলোচিত ফরিদপুর-৪ নির্বাচনী এলাকাটি। সেখানে বাঘে-সিংহে না হলেও কাজী ও চৌধুরীর মধ্যকার লড়াই বেশ জমে উঠেছে। একদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, অন্যদিকে স্বতন্ত্র সাংসদ মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন (যিনি নিক্সন চৌধুরী নামেই বেশি পরিচিত)। নিক্সন পর পর দুবার জাফর উল্যাহকে হারিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। তিনিও আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য। তাঁর বড় ভাই নূরে আলম চৌধুরী বর্তমানে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ।

২০০১ সালে যখন আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময় ছিল তখন কাজী জাফর উল্যাহ বিএনপি প্রার্থীকে হারিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সংসদে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা ছিল ৬২। ২০০৮ সালে মামলার কারণে তিনি নির্বাচন করতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী নিলুফার চৌধুরী সাংসদ হয়েছিলেন।

মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ও কাজী জাফর উল্যাহ
সংগৃহীত

সম্প্রতি চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদের মধ্যে যে বিরোধ তার পেছনে রাজনৈতিক বা আদর্শগত কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্বটা হলো ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির। নেতার সঙ্গে নেতার। ফরিদপুরের এই আসনটি ২০০১ সাল থেকে বিএনপির হাতছাড়া। আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য। চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল গত মার্চ মাসে। করোনার কারণে স্থগিত করা হয়েছিল। সে সময়ে কাজী জাফর উল্যাহর সমর্থক মো. কাউসারকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। কাজী সাহেব আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর প্রার্থীর কথা এলাকায় ঘোষণাও করেছিলেন। এর মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যায়। কাউসার মনোনয়ন পাওয়ার পর পক্ষ ত্যাগ করে নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে হাত মেলান। দলের আরও অনেক নেতা-কর্মী তাঁকে অনুসরণ করেন।

উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চরভদ্রাসন উপজেলা আওয়ামী লীগ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে বহিষ্কার করে। জেলা কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটিকে নালিশ জানায়। তারপরও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. কাউসারের জয় নিশ্চিত ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রার্থী ছিলেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে বিএনপির প্রার্থী আগেই রণেভঙ্গ দেন। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি ভোট পাবেন এটিও কেউ মনে করেননি। কিন্তু প্রশাসন নিয়ে কিছুটা ভয় ছিল।

ফলে কাজী চৌধুরীর দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে প্রশাসনেও। ফরিদপুর জেলা প্রশাসন কাজী সাহেবের প্রতি এবং পুলিশ সুপার নিক্সন চৌধুরীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। ফলে নিক্সন অনুসারীদের ভয় ছিল, প্রশাসন তাঁদের প্রার্থীকে হারিয়ে দিতে পারে। এ জন্য তাঁরা জোরালো রণ প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামেন। আবার প্রশাসন নির্বাচন জবরদস্তি বন্ধ করতে ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে।

এরপর দ্রুত ঘটনা ঘটতে থাকে। ইউএনওর সঙ্গে সাংসদের টেলিফোন সংলাপ ভাইরাল হলে জেলা প্রশাসন নালিশ জানায় জনপ্রশাসন বিভাগে। তারা অভিযোগ করে নির্বাচন কমিশনকে। ত্বরিত মামলা হয় সাংসদের বিরুদ্ধে। প্রশাসন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সাংসদ হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিনের আবেদন করেন এবং জামিন পেয়েও যান। তবে শর্ত থাকে যে তিনি প্রশাসনকে হুমকি দিতে পারবেন না। এর আগে সাংসদ জেলা প্রশাসককেও ‘রাজাকার’ করে গালমন্দ করেছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিক্সন চৌধুরীর অনেকগুলো বক্তৃতা ভাইরাল হয়েছে। এসব বক্তৃতায় তিনি কাজী জাফর উল্যাহকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছেন। তাঁকে ‘রাজাকার’ ‘আলবদর’ বলে গালাগাল করেছেন। কাজী জাফর উল্যাহর মন্ত্রী হওয়ার গুঞ্জন নিয়েও ঠাট্টা করেছেন নিক্সন। বলেছেন, পাঁচ বছর ধরেই শুনে এসেছি তিনি মন্ত্রী হচ্ছেন। দুর্বল খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলে তিনি আনন্দ পান না মন্তব্য করে নিক্সন বলেন, ‘মন্ত্রী হয়ে আসুন। খেলাটা জমবে’।

কাজী জাফর উল্যাহ দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য। যে আওয়ামী লীগ রাজাকার-আলবদরদের বিচার করেছে, সেই দলে রাজাকার আলবদর আছেন, তা-ও দলের প্রেসিডিয়ামে! আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে সাংসদের এই বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করেছে বলে আমাদের জানা নেই। তাহলে কি দল নিক্সন চৌধুরীর অভিযোগ মেনে নিয়েছে?

সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে কেবল নিক্সন চৌধুরীর বক্তৃতা ভাইরাল হয়নি। ভাইরাল হয়েছে কাজী জাফর উল্যাহর বক্তৃতাও। তিনি বলেছেন, নিক্সন আওয়ামী লীগের কেউ নন। যিনি নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন, তিনি আওয়ামী লীগের কেউ হতে পারেন না। জাফর উল্যাহর সহযোগীরা নিক্সনকে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও খালাসি বলে গালমন্দ করেছেন। আবার নিক্সনের সহযোগীরা কাজী জাফর উল্যাহকে এলাকায় না আসার জন্য হুমকি দিয়েছেন।

দুই পক্ষই কোমর বেঁধে নেমেছে। দুই পক্ষ একে অপরকে ‘নকল আওয়ামী লীগার এবং নিজেদের ‘আসল আওয়ামী লীগার’ বলে প্রচার চালাচ্ছে। কাজী জাফর উল্যাহ পত্রিকান্তরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাংসদ নিক্সন শুধু প্রশাসনের কর্মকর্তা নন, আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, এমনকি মন্ত্রীদেরও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। তিনি বলেন, ‘ইউএনওকে গালাগালের বিষয়ে কিছু বলার নেই। আমাকেই তো এ রকম অকথ্য ভাষায় অনেক গালাগাল করেছে। এগুলোও ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু আমরা তো কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। অনেক মন্ত্রীকে নিয়েও অকথ্য ভাষায় কথা বলে।’ তিনি আরও বলেন, সে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট করে আবার অনুষ্ঠানের ব্যানারে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সভাপতির ছবি ব্যবহার করে। এটা তো সে পারে না। কিন্তু তাকে থামাবে কে? সম্প্রতি সে ব্যানার, পোস্টার ছাপিয়েছে, তাকে যুবলীগের ১ নম্বর প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখন দেশজুড়ে যুবলীগের কমিটি গঠনের কাজে সে তৎপর হবে। (কালের কণ্ঠ, ২০ অক্টোবর, ২০২০)

নিক্সন চৌধুরী গত জাতীয় নির্বাচনের পর জাফর উল্যাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বলেছিলেন, তিনি (কাজী জাফরউল্লাহ) এখন জনবিচ্ছিন্ন একজন নেতা। তার খামখেয়ালিপনা ও নমিনেশন বাণিজ্যসহ দুর্নীতির কারণে ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসনের উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের শত শত নেতা-কর্মী তাকে প্রত্যাখ্যান করে আমার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর তিনি নৌকায় উঠবেন।

এখন ফরিদপুর-৪ আসনে যা হচ্ছে, সেটি নৌকায় ওঠার প্রতিযোগিতা মাত্র। নৌকা দুজনকে নিতে পারবে না। নতুন চড়নদার এলে পুরোনোকে নামতে হবে। ফলে এই লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফল দেখতে এলাকাবাসীকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক