সম্প্রতি তিস্তা নদীতে কয়েকবার গিয়েছিলাম। গত মার্চে একদিন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর শেখ হাসিনা সেতু থেকে নৌকাযোগে উজানে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়েছিলাম। নৌকায় যেতে যেতে নদীপারের বিচিত্র জীবন দেখলাম। সেতু থেকে উজানে যেতে দেখছিলাম, অনেক মানুষ নদীর পাড় ধরে উজানের দিকে যাচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, এরা যাচ্ছে কোথায়। কিছুক্ষণ পরই দেখলাম, বিনবিনার চরে নদীর পাড় ঘেঁষে একটি স্থানে অনেক মানুষ। মাঝিকে অনুরোধ করে বিনবিনার চরের জনসমাগমস্থলে পৌঁছাই।
জনসমাগমস্থলে গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের বিনবিনার চরে কেউ কোদাল, কেউ বাঁশ, কেউ বাঁশের চাটাই নিয়ে আসছেন। জনসমাগমের ভেতরেই একজন বলছেন, ‘মাইকে ঘোষণা দেও, সবাই কোদাল নিয়ে আসুক। আরও কোদাল নাগবে।’ এ কথা বলতেই একজন মাইকে ঘোষণা করার জন্য চলে গেলেন। দেখলাম, গাছে মাইক বেঁধে রাখা। শিশু-বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ এসেছে। কয়েকটি মেশিনে বালু তুলে বাঁধ দেওয়ার কাজ চলছে। অনেকগুলো বাঁশ নদীর মধ্যে আড়াআড়ি করে খুঁটি দেওয়া হয়েছে। গ্রাম সুরক্ষার সরকারি ব্যবস্থাপনা না থাকায় স্থানীয় ব্যক্তিরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন।
রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা, লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের এবং আদিতমারী উপজেলার তুষভালার ইউনিয়নের লোকজন মূলত জমায়েত হয়েছে। যাতে আগামী বর্ষায় তিস্তা নদীর বাঁ তীর আর না ভাঙে, সে জন্য স্থানীয় ব্যক্তিরা উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের টাকায় বাঁধ তৈরি করছে। ২০০৫ সালে একবার চার শ ফুট বাঁধ তৈরি করেছিলেন স্থানীয় ব্যক্তিরাই।
২০১৭ সালে ভয়াবহ বন্যায় বিনবিনার চরের কাছে নদী খানিকটা ভেঙে অনেক পুরোনো খাতে তিস্তা প্রবাহিত হয়েছিল। স্থানীয় ব্যক্তিরা অনেক চেষ্টা করেও সরকারের মাধ্যমে সেই ভাঙাটুকু বন্ধ করাতে পারেননি। সেবার গজঘণ্টা এবং কাকিনার লোকজন মিলে অনেক বাঁশ কেটে এনেছিল ভাঙাটুকু বন্ধ করার জন্য। কিন্তু ২০১৮ সালে ভারতে আগাম বৃষ্টি হওয়ায় গজলডোবার সব কটি বাঁধ একসঙ্গে খুলে দিলে বাংলাদেশেও ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা সেচ প্রকল্পের বাঁধের সব কটি গেট খুলে দিতে হয়েছিল। সে বছর তিস্তা নদী প্রায় ১৫ কিলোমিটার নতুন প্রবাহ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। হাজার হাজার বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে গেছে সে বছর। গত বছরও তিস্তা অনেক বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে গেছে। শংকরদহ নামের একটি গ্রামে কোনো বাড়িঘর নেই। নদীপারের মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, যদি নদীর পানি মূল প্রবাহে প্রবাহিত করা না যায়, তাহলে বিনবিনার চরের পাশের সব বাড়ি ভেঙে নিয়ে যাবে। সে কারণেই নিজেদের টাকায় চলছে বাঁধ নির্মাণের কাজ।
গঙ্গাচড়ার বিনবিনা, পশ্চিম ইচলি, পূর্ব ইচলি, শংকরদহ, জয়রাম মাজার, কাশিয়াবাড়ি, চর ইশরকুল ছাড়াও আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী, নামুড়ি ও কালীগঞ্জ উপজেলার মহিষামুড়ি ও রুদ্রেশ্বর এলাকার হাজার হাজার বাড়িঘর রক্ষা করার জন্য মূলত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল।
গ্রাম রক্ষা বাঁধ দেওয়ার টাকা জোগাড় করতে বাড়িতে পালন করা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল বিক্রি করছেন অনেকেই। যঁার টাকা দেওয়ার একেবারেই সামর্থ্য নেই, তঁাকেও দিতে হয়েছে ন্যূনতম এক হাজার টাকা। চড়া সুদে টাকা নিয়েও অনেকেই টাকা দিয়েছেন। এই টাকা সংগ্রহের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১০৯ সদস্যের কমিটি এবং ৪৫ জন উপদেষ্টা আছেন। কমিটির নাম ‘বিনবিনা পাকার মাথা স্বেচ্ছাসেবক বাঁধ নির্মাণ কমিটি’।
বাঁধটি নির্মাণের জন্য ওই সব অঞ্চলের মানুষ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন। প্রাথমিক অবস্থায় ৮ লাখ টাকা চাঁদা উঠেছিল। তঁাদের ওই বাঁধটুকু নির্মাণ করতে প্রায় ১৭ লাখ টাকা প্রয়োজন ছিল। তবে বাঁধের সুরক্ষার জন্য কোটি টাকা লাগত। এই এক কোটি টাকা তঁারা সংগ্রহ করতে পারবেন না বলে বাঁধ দ্রুত ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন।
টাকা যা উঠছে, তার হিসাবে ছিল স্বচ্ছতা। সবাইকে জানানো হতো, কত টাকা উঠেছে। কে কত টাকা দিয়েছে, কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হচ্ছে, তার সবকিছুই লিখিত। বিনবিনা পাকার মাথা স্বেচ্ছাসেবক বাঁধ নির্মাণ কমিটির আহ্বায়ক মমতাজুল ইসলাম। গত বছর তাঁর বাড়িঘর সব নদীতে ভেঙে গেছে। এখন রাস্তার ওপরে বাড়ি করে আছেন।
অনেক দিন ধরে তাঁরা কাজ করেছেন। আমি মার্চ মাসে যখন ওই এলাকায় গিয়েছিলাম, তখন বাঁধের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পানির প্রবাহ ভিন্ন দিকে নেওয়া হবে। স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মাণ করা সেই বাঁধ বর্ষা আসার আগেই সামান্য বৃষ্টির পানিতে ভেঙে গেল।
স্থানীয় ব্যক্তিদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাজাত আশঙ্কা যদি সত্য হয়, তাহলে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হবে এ বর্ষায়। পার্শ্ববর্তী শংকরদহ গ্রামের মতো অসংখ্য গ্রাম এ বছর নদীগর্ভে মিলিয়ে যাবে। সরকার তঁাদের পাশে নেই, নিজেদের চেষ্টাও ব্যর্থ। এখন প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা ছাড়া আর তঁাদের কোনো পথই খোলা নেই।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক