আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানের উগ্রপন্থী ইসলামি গোষ্ঠীগুলো সীমান্ত অঞ্চলে তাদের হামলা বাড়িয়েছে। এতে ইসলামাবাদ তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বাধ্য হয়েছে। সশস্ত্র এই গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানের গোত্রপ্রধান এলাকায় সক্রিয়। বিশ্ব পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে তালেবান যে সফলতা দেখিয়েছে, তাতে উৎসাহিত হয়েছে তারা।
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এ রকমই একটি গোষ্ঠী। আফগানিস্তানের তালেবানের মতো তাদেরও একই রকম ইতিহাস রয়েছে। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা ভয়ানক সহিংসতায় মত্ত রয়েছে। টিটিপির সিংহভাগ সদস্য জাতিগতভাবে পশতুন। দেশজুড়ে শত শত আত্মঘাতী বোমা হামলা ও অপহরণের সঙ্গে তারা জড়িত।
সীমান্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। তাদের শাসনাধীন এলাকায় কট্টর ইসলামি আইন জারি আছে। নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই যখন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সে সময় তাকে গুলি করেছিল টিটিপির সদস্যরা। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটির যোগসূত্র রয়েছে।
এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরও ২০১৪ সালের আগপর্যন্ত টিটিপির বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পেশোয়ারের একটি বিদ্যালয়ে গুলি চালিয়ে টিটিপির যোদ্ধারা ১৫০ শিশুকে হত্যা করলে সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। এতে টিটিপি আন্দোলন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, সংগঠনটির সদস্যরা আফগানিস্তানে পালিয়ে যায়।
এক দশক পর এবং আফগানিস্তানে তালেবান শাসনক্ষমতায় ফিরে আসার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান টিটিপির পুনরুত্থান ঠেকানোর চেষ্টা করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টিটিপির একজন যোদ্ধা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘তালেবানের হাতে কাবুল পতনের পর এখন আমাদের যোদ্ধারা আফগানিস্তানে আরও মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারছে। মার্কিন ড্রোন হামলার কোনো ভয় এখন আর আমাদের নেই। আমরা এখন খুব সহজেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাৎ করতে পারছি।’
এ বছরের আগস্ট মাসে ৩২, সেপ্টেম্বর মাসে ৩৭ ও অক্টোবর মাসে ২৪টি হামলা চালিয়েছে টিটিপি। মাসের হিসাব বিবেচনায় গত পাঁচ বছরের মধ্যে হামলার এ সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই টিটিপি তাদের হামলা জোরদার করে। এ সময়ে ১৪৯টি হামলার ঘটনা ঘটে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় তিন গুণ।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার প্রথম দফা ক্ষমতার অর্ধেকটা পার করেছেন। নির্বাচনের সময় পাকিস্তানের রক্ষণশীল অংশের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকার পরও টিটিপির মতো গোষ্ঠী গ্রামের ভোটারদের ইমরানকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
কট্টরপন্থী গোষ্ঠীটির এই পুনরুজ্জীবিত আত্মবিশ্বাস আরও স্পষ্ট করে প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর মাসে। তাদের দলনেতা নুর ওয়ালি মেসউদ তখন ফেরারি জীবন থেকে প্রকাশ্যে আসেন। একটি আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে, জনসমক্ষে তিনি হাত নেড়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। কয়েক মাস আগেও এ চিত্র ছিল কল্পনাতীত। ২০২০ সালের জুলাইয়ের পর এক ডজনের বেশি ইসলামি উপদল মেসউদের নেতৃত্বে বশ্যতা মেনেছে।
টিটিপির ভাবমূর্তি উন্নয়ন এবং ইসলামিক স্টেটের চরমপন্থা থেকে নিজেদের পৃথক করার জন্য মেসউদ নতুন একটা পথ বেছে নিয়েছেন। বেসামরিক নাগরিকদের এড়িয়ে, শুধু নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সাম্প্রতিক হামলাগুলোয় অনেক কম প্রাণহানি হচ্ছে। আগের বোমা হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি হতো, সে সব হামলা দেশবাসীকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলত।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার প্রথম দফা ক্ষমতার অর্ধেকটা পার করেছেন। নির্বাচনের সময় পাকিস্তানের রক্ষণশীল অংশের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকার পরও টিটিপির মতো গোষ্ঠী গ্রামের ভোটারদের ইমরানকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
গত অক্টোবরে ইমরান খান ঘোষণা দেন, তাঁর সরকার টিটিপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে। দুই পক্ষই ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়, যাতে তারা একটা চুক্তিতে আসতে পারে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওহাদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের আইন ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যারা ফিরে আসতে চাই, তাদের আমরা আরেকবার সুযোগ দেব।’ তবে কোন কোন বিষয়ে আপসরফা হবে, তা নিয়ে কোনো পক্ষই এখনো মুখ খোলেনি।
সশস্ত্র গোষ্ঠীটির একটি সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, টিটিপির ১০০ যোদ্ধার মুক্তি অস্ত্রবিরতির প্রধান শর্ত। ফেরারি জীবন থেকে গোত্রপ্রধান এলাকায় প্রকাশ্যে অবস্থানেরও সুযোগ চায় তারা। বিগত বছরগুলোতে এসব গোত্রের শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাই তাদের নেতাদের সমর্থন ছাড়া এ ধরনের কোনো চুক্তি অর্থপূর্ণ হবে না।
এ রকম একটি গোত্রের নেতা বাদশা। তিনি এএফপিকে বলেন, অস্ত্র সমর্পণ ছাড়া তাদের (টিটিপি) ফেরা খুব কঠিন। তারা অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। ফলে তাদের অনেক শত্রু আছে। তিনি আরও বলেন, তালেবানের প্রতি টিটিপির বিদ্বেষ আছে সত্যি। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের গ্রহণ করতে হবে, যদি তারা সমস্যার সমাধান চায়। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, শান্তি আলোচনায় তাঁদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাঁরা টিটিপির হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
অনেকগুলো উপদল নিয়ে টিটিপি গড়ে উঠেছে। এদের কোনো কোনো অংশ আবার আল-কায়েদার বশ্যতাও স্বীকার করেছে। টিটিপি আফগানিস্তানের তালেবান থেকে পৃথক একটি গোষ্ঠী। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মনে করে, টিটিপির চার থেকে ছয় হাজার যোদ্ধা রয়েছে। শূন্য থেকে শুরু করে একপর্যায়ে তাদের যোদ্ধাসংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ হাজারে পৌঁছেছিল।
২০১৪ সালের পর মার্কিন ড্রোনের সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানে টিটিপির নেতৃত্ব উপড়ে ফেলা হয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিস্তানের একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, আট বছর আগের সেই একই গোষ্ঠী এই টিটিপি নয়। টিটিপির তরুণ যোদ্ধা ও তৃতীয় স্তরের নেতাদের সঙ্গে এখন শান্তি আলোচনা চলছে।
কিন্তু এই শান্তি আলোচনায় দুই পক্ষের প্রতিই অনেক পাকিস্তানির মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিদ্যালয়, হোটেল, গির্জা, বাজারে যেসব ভয়ানক হামলা টিটিপি চালিয়েছিল, সেসব ভয়ানক স্মৃতি তাদের মনে আছে। সেসব হামলায় কমপক্ষে ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। শান্তিচুক্তির আগে টিটিপির যোদ্ধারা প্রকাশ্যে আসার কথা নয়। কিন্তু মেসউদ গোত্রের একজন নেতা জানান, বিশেষ করে রাতের বেলায় টিটিপির উপস্থিতি এখনই পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বাস করেন দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান। তাঁদের গোত্রের লোকজন আফগানিস্তানের তালেবানকে পছন্দ করে।
অনেকে মনে করেন, টিটিপির ফিরে আসা মানে সহিংসতার নতুন যুগের সূচনা।
এএফপি থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সিরিল বেলাউদ ও সাজ্জাদ তারাকজাই এএফপির সাংবাদিক