মহামতি বুদ্ধ তখন বৃদ্ধ। এক চালবাজ এসে জুটল। কিছুদিন বুদ্ধের সঙ্গে থেকে কিছু টেকনিক শিখে নিতে পারলে বুদ্ধ মারা যাওয়ার পরই নিজেকে বুদ্ধের অবতার বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে—এই তার আশা। ভণ্ড নিবেদিতপ্রাণ শিষ্য সেজে বুদ্ধের সেবাযত্ন করতে লাগল। বুদ্ধ চালবাজটির মতলব বুঝলেও বললেন না কিছুই। বছর দুই পার হলো। ভণ্ড শিষ্য বুঝতে পারল যে ধ্যানের ক্ষমতা বা আধ্যাত্মিক শক্তির কিছুই সে লাভ করতে পারেনি। কারণ, যার অন্তরের নিয়ত বা অভিপ্রায় পরিষ্কার নয়, সে ধ্যানের ক্ষমতা লাভ করতে পারে না।
ক্ষুব্ধ শিষ্য তখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। এক ভোরে বুদ্ধকে একা পেয়ে যা–তা ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল। বুদ্ধ চুপচাপ শুনে গেলেন।
চালবাজ থামলে বুদ্ধ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, একটা প্রশ্ন করতে পারি?
শিষ্যের মেজাজ তখনো খিঁচে আছে। ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল, কী জিজ্ঞেস করবেন?
বুদ্ধ বললেন, ধরো, তোমার কোনো জিনিস তুমি কাউকে দিতে চাচ্ছ, কিন্তু সে যদি না নেয়, তাহলে জিনিসগুলো কার থাকবে?
উত্তেজিত শিষ্য তখন বলল, এ–ও বোঝেন না? না নিলে আমার জিনিস আমারই থাকবে।
বুদ্ধ আবার জিজ্ঞেস করলেন, যাকে দিতে চাচ্ছ, সে না নিলে তোমারই থাকবে?
মহাবিরক্ত ভণ্ডের উত্তর, হ্যাঁ, আমার থাকবে।
বুদ্ধ এবার বললেন, তাহলে এতক্ষণ আমাকে তুমি যা উপহার দিলে, আমি তার কিছুই নিলাম না।
সিদ্ধার্থ ধ্যানী ছিলেন বলেই সক্রিয় হতে পেরেছিলেন, আর সক্রিয় ছিলেন বলেই মহামতি হতে পেরেছিলেন এবং অমরত্ব লাভ করেছিলেন। সক্রিয় মানুষ সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখেন। মাথা ঠান্ডা রেখে মগজকে বেশি কাজে লাগানোই মেডিটেশন বা ধ্যানের লক্ষ্য। অবশ্য ধ্যান বুদ্ধকে শুধু সক্রিয়ই করেনি, সৎ, বিনয়ী, দয়ালু, সময়ানুবর্তী, পরিশ্রমী করে তুলেছিল। সেদিন বুদ্ধ যদি চালবাজ শিষ্যের মতো উত্তেজিত হতেন, তাহলে তিরোধানের শত শত বছর পরেও আজ তাঁকে পৃথিবী মনে রাখত না। ২০২১–এর মেডিটেশন দিবসে এ ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা বড্ড বেশি। চারদিকে অস্থিরতা আর হতাশা। নেতিবাচকতা আর অসততা। রাজপথে পরিবহন ভাঙচুর থেকে শুরু করে দুই যুগের অধিক কালের দাম্পত্য জীবনে ভাঙচুর, কিংবা করোনার চেয়ে করোনা-আতঙ্কে বেশি বিপর্যস্ত হওয়া—এসবই রিঅ্যাকটিভ আচরণের ফল।
আমরা যারা অমরত্বের ধার ধারি না, খাইদাই ফুর্তি করি গোছের মানুষ, সামান্য দুই টাকার ভাড়া নিয়ে রিকশাচালকের গায়ে হাত তুলি, কিংবা সারা দিনের কাজ শেষে ঘরে ফেরার পর কর্তার খিটখিটে মেজাজে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে পরিবারের সদস্যরা, তাদের জীবনদৃষ্টি ঠিকঠাক করার জন্য ধ্যান বা মেডিটেশন আরও বেশি দরকার। এ বছর মেডিটেশন দিবসের প্রতিপাদ্যের দিকে তাকালেই বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। এ বছরের প্রতিপাদ্য: নিয়মিত মেডিটেশন: সুস্থ সফল সুখী জীবন। পৃথিবীতে এমন মানুষ কি আছেন, যিনি সুস্থ সফল সুখী জীবন চান না?
সারা পৃথিবীর মেডিটেশনপ্রিয় এবং মেডিটেশন থেকে উপকৃত মানুষেরা অনানুষ্ঠানিকভাবে দিনটি পালন করে আসছে বেশ কয়েক বছর। ব্রিটিশ নাগরিক উইল উইলিয়ামস মেডিটেশন দিবসের উদ্যোক্তা। উইল একসময় অনিদ্রায় ভুগতেন। এর সমাধানে দুহাতে জ্বলন্ত মোম লাগানো থেকে দেয়ালে আঘাত করে নিজেকে আহত করা পর্যন্ত অনেক কিছুই করেছেন, কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। অবশেষে মেডিটেশন করে নিরাময় লাভ করেন।
মেডিটেশন যে কেবল আরামের ঘুম এনে দেয় তা–ই নয়, মাথা ঠান্ডা রেখে যেকোনো অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে প্রজ্ঞার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতেও এটি সাহায্য করে। ঠান্ডা মাথায় নেওয়া পদক্ষেপের ফলে কীভাবে একদল শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে একজন মানুষ নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে, তারই চমৎকার বাস্তব উদাহরণ রবার্ট মুলার।
১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে নাৎসি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীর যুদ্ধ চলছে। এ বাহিনীর সক্রিয়া সদস্য রবার্ট মুলার পারিজোঁ ছদ্মনামে তাঁবেদার ভিকি সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হন। উদ্দেশ্য, জার্মান সৈন্যদের চলাচল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। হঠাৎ সংবাদ পান, গেস্টাপো বাহিনী তাকে ধরার জন্য আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার কাছে খবর আসে, গেস্টাপো চররা তন্নতন্ন করে এ ভবনে তল্লাশি চালাচ্ছে। মুলার কিছুদিন ধরেই ফরাসি মনোবিদ ড. এমিল কোয়ের ইতিবাচক চিন্তা–পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছিলেন।
এ রকম বিপদের সময় মুলার কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে ভাবলেন, এ ঘটনাকে একটি থ্রিলার অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে দেখা যেতে পারে। বাস্তব বিপদকে অ্যাডভেঞ্চার ভাবতে পারায় তিনি অনুভব করলেন, তার মনটা শান্ত হয়ে গেছে। মাথা ঠান্ডা হওয়ায় ঠিক করলেন, নাৎসিদের চোখের সামনে দিয়েই তিনি হেঁটে বেরিয়ে যাবেন। এটা তাদের প্রত্যাশারও অতীত। দৃশ্যটি তিনি কল্পনাও করে নিলেন। বুঝলেন হাতে সময় খুব সামান্য। দ্রুত প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে চশমা খুলে ফেললেন। চুল পানি দিয়ে ভিজিয়ে মাথার সঙ্গে লেপ্টে দিলেন। একটা সিগারেট ধরালেন। বজায় রাখলেন নির্লিপ্ত শান্ত একটা ভাব।
একটা ফাইল হাতে নিয়ে নিচে নেমে এলেন সেক্রেটারির কাছে। গেস্টাপো সৈন্যরা তখন সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। তিনি আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলেন কী ঘটনা। সেক্রেটারি চোখের পলক না ফেলেই বলল, এই ভদ্রলোকেরা মি. পারিজোঁকে খুঁজছেন।
‘পারিজোঁ?’ তিনি যেন বিস্মিত। ‘আমি তো তাকে কয়েক মিনিট আগে পাঁচতলায় দেখেছি।’
গেস্টাপোর লোকেরা পাঁচতলার উদ্দেশে ছুটল আর মুলার ছুটলেন ভবন থেকে বের হবার গেটের দিকে।
শুধু ঠান্ডা মাথায় ইতিবাচক চিন্তার ফলে মুলার গেস্টাপোর হাতে ধরা না পড়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। অনেকে এ ঘটনাকে ব্যতিক্রমী, বিরল, সিনেমাটিক ইত্যাদি আখ্যা দিলেও অস্বীকার করার জো নেই যে এটি বাস্তব। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের মস্তিষ্ক বাস্তব ও কল্পনার মাঝে ফারাক করতে পারে না (উদাহরণ: সিনেমায় কান্নার দৃশ্য দেখলে আমরাও কাঁদি)। এ সূত্রই কাজে লাগিয়েছিলেন মুলার। কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে মার্কিন নিউরোসায়েন্টিস্ট জো ডিসপেনজার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম দুর্ঘটনার পর অপারেশন ছাড়া শুধু ধ্যানচর্চায় নিরাময় লাভের ঘটনাটিও কিন্তু বাস্তব। ১৯৮৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া শহরে ৫৫ কিমি গতিতে ছুটে আসা একটি ফোর হুইলার বাইসাইকেল-আরোহী জো-কে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে তিনি ছিটকে দূরে পড়ে যান। তাঁর ছয়টি কশেরুকা সংকুচিত হয়ে যায়। জীবনে আর হাঁটতে পারবেন না এবং বাঁচতে হলে অনতিবিলম্বে হ্যারিংটন রড সার্জারি করাতে হবে, সেরা হাসপাতালের সেরা চিকিৎসকদের এই পরামর্শ অগ্রাহ্য করে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জো। হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে যান। একটা একটা করে কশেরুকা তার আগের কাঠামোতে ফিরে আসছে, তার পুরো দেহ স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্পন্ন করছে, ছয় সপ্তাহ যাবৎ এই দৃশ্যকল্প রচনা করে দৈনিক তিন ঘণ্টা করে মনের চোখে দেখতে লাগলেন (যাকে বলা হয় মনছবি)। প্রথম দিকে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলেও ছয় সপ্তাহে তিনি মস্তিষ্ককে সফলভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারলেন যে এভাবেই তিনি সুস্থ হবেন। ক্রমশ অনুভব করলেন, শরীর যেন সাড়া দিচ্ছে তার মনছবিতে। ১০ সপ্তাহের মাথায় নিজে পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ১২ সপ্তাহের মাথায় কর্মস্থলে ফিরে গেলেন। মন এবং দেহের এমন নিবিড় সংযোগের ফল হাতেনাতে পেয়ে এবং ধ্যানের শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, এ বিষয়ে সাধনা করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন।
কেন ঘটে এ রূপান্তর? মন, দেহ ও পারিপার্শ্বিকতা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যদি আমরা মন ও চিন্তার শক্তিকে সৃজনশীল ও ফলপ্রসূভাবে ব্যবহার করতে পারি, সুসংহত মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি, তাহলে সুখ ও সাফল্য সৃষ্টি হয়। মেডিটেশন মনের শক্তিকে কাজে লাগাতে শেখায়। নিয়মিত মেডিটেশনে ব্রেনের নিউরনগুলোর মাঝে চমৎকার সংযোগ ঘটে, শরীর শিথিল হয় এবং শরীরের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব থেকে থেকে মন মুক্তি পায়।
ডা. হার্বার্ট বেনসন দীর্ঘদিন গবেষণা শেষে প্রমাণ করেছেন, শরীর শিথিল হলে হার্টবিট, দেহে ব্যথার অনুভূতি ও উচ্চ রক্তচাপ কমে। দম ধীরগতি লাভ করে। রক্তে অ্যাড্রেনালিনের পরিমাণ ও ল্যাকটেটের লেভেল কমে। দেহে অক্সিজেন গ্রহণ কমে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে। ফলে শরীর আপনা থেকেই রোগমুক্তির প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে। আসলে শরীর শিথিল হবার প্রথম প্রাপ্তিই হলো প্রশান্তি। যতই আপনি প্রশান্তিতে অবগাহন করবেন, দেখবেন, টেনশন বা দুশ্চিন্তা, রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা ধারেকাছে আসতে পারছে না। সে কারণেই মেডিটেশন সুস্থ, সফল, সুখী জীবনের সন্ধান দেয়।
করোনার পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন শিক্ষালয় অনলাইন শিক্ষা দান করতে গিয়ে দেখেছে, সারাক্ষণ ডিভাইসের সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অস্থির ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে এসব প্রতিষ্ঠান যে কাজগুলো করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপদেশ দিচ্ছে, তার মধ্যে ধ্যানচর্চা অন্যতম। বাংলাদেশও বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বছরের ২২ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলার প্রস্তুতি গ্রহণ বিষয়ে। এ প্রজ্ঞাপনে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য যে কাজগুলো শুরু করার নির্দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়েছে, সে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মেডিটেশন চর্চা। কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার কথা ভেবে মেডিটেশন দিবসে অন্তত এই একটি দিকেই না হয় আমরা মনোযোগ দিই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের সদস্যরা যেন নিয়মিত মেডিটেশন করেন, সে কাজটি কি এখনই শুরু করা উচিত নয়?
তথ্যসূত্র: ইউ আর প্লাসিবো: মোস্ট অব অল দে টট মি হ্যাপিনেস (১৯৭৮), কোয়ান্টাম মেথড (১৯৯৩), মেকিং ইয়োর মাইন্ড ম্যাটার (২০১৪)
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এবং সমন্বয়কারী, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়