গত ২৩ জুলাই শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা ইউনিয়নের নুরুদ্দিন মাদবরকান্দি এসইএসডিপি মডেল উচ্চবিদ্যালয় ভবনটি পদ্মা নদীর প্রবল স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত তিনতলা ভবনটিতে এক হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী শিক্ষা গ্রহণ করত। স্কুলটি ওই এলাকার বাতিঘর বলে পরিচিত ছিল। স্কুলটি নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার ছবিটি দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। মাত্র এক সপ্তাহ যেতে না–যেতে শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের আরেকটি তিনতলা প্রাইমারি স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার একইভাবে নদীগর্ভে বিলীন হয়। এ ছাড়া আরও অনেক স্কুল ভবন নদীগর্ভে বিলীন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আশপাশের আরও প্রাইমারি স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক, হাটবাজার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটা বিচিত্র কিছু নয়। এমনকি নদীপাড় থেকে তিন-চার কিলোমিটার ভেতরে নির্মাণ করা স্থাপনাও কোনো এক সময় নদীভাঙনের কবলে পড়তে পারে। এই ভবনগুলো আরসিসি ফ্রেমের ওপর তৈরি। সেই ফ্রেমের মধ্যে সনাতনী লাল ইট ব্যবহার করে দেয়াল গাঁথা হয়। তারপর ফ্রেম ও ইটের দেয়াল বালু-সিমেন্ট দিয়ে প্লাস্টার করা হয়। বর্তমানে এমন ভবন নির্মাণ করাই প্রচলিত। তবে এমন পাকা ভবনকে নদীভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য করার কিছুই থাকে না। এমন স্থাপনার নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ছবি যখন আমরা দেখি, তখন আমরা ‘হায় হায়’ করে উঠি। করার কি কিছুই আসলে নেই? অবশ্যই আছে। বিকল্প হচ্ছে আরসিসি ফ্রেমের বদলে ইংরেজি এইচ শেপের স্টিল সেকশনের মেম্বার দিয়ে কলাম ও বিমের ফ্রেম বানানো। একটার সঙ্গে আরেকটা নাট-বোল্ট দিয়ে যুক্ত করতে হবে (ওয়েল্ডিং করে নয়)। নাট-বোল্ট দিয়ে যুক্ত করার উদ্দেশ্য হলো, যেন প্রয়োজনে খুব কম সময়ে খুলে ফেলা যায়। এমন স্টিলের ফ্রেম রং করে বহুদিন ব্যবহার করা যায়। যেমন ১০৫ বছর ধরে চলছে স্টিলের তৈরি পাকশী ব্রিজ।
একতলা ভবন করা ভালো। জায়গার অভাব থাকলে তিন-চারতলা ভবন করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কম খরচের স্ল্যাব নির্মাণ করতে হবে। মনে রাখা দরকার, চরাঞ্চল বা নদীর কাছাকাছি স্থাপনা যেকোনো সময় খুলে ফেলতে হতে পারে। সুতরাং কাঠামোসহ অন্যান্য উপাদান এমন জিনিস দিয়ে তৈরি করা দরকার, যেন এক দিনের নোটিশে খুলে ফেলা যায়।
স্টিলের তৈরি কলাম-বিমের বাইরের পাশের ফ্রেমের মধ্যে ইনফিল ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ব্লক ব্যবহার করে দেয়াল গাঁথতে হবে। এতে শ্রেণিকক্ষ কম গরম হবে। ভবনটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হলে বাইরের পাশের এ দেয়াল ভেঙে ফেলতে হবে। ভেতরের ফ্রেমের (পার্টিশন ওয়াল) মধ্যে ইনফিল ম্যাটেরিয়াল হিসেবে আরও সস্তা জিনিস ব্যবহার করা যায়। কুচি কুচি করা খড়কুটোর সঙ্গে মিহি বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করে পাঁচ ইঞ্চি পুরু দেয়াল ঢালাই দিয়ে তৈরি করা যায়। এ দেয়ালের খরচ সনাতনী ইটের দেয়াল থেকে অর্ধেকের কম পড়বে। এ ছাড়া এইচবিআরআইয়ের (হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট) উদ্ভাবিত ফেরোসিমেন্ট দিয়ে পার্টিশন ওয়াল তৈরি করা যেতে পারে। এগুলো প্যানেল টাইপের, ফলে খুলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যাবে।
স্টিল ফ্রেমের ওপর তৈরি ভবনটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হলে প্রথমে বাইরের দেয়াল ও ভেতরের পার্টিশন ওয়াল ভেঙে ফেলতে হবে। এরপর নাট-বোল্ট খুলে কলাম-বিমের পুরো ফ্রেম খুলে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যাবে। ফলে খরচ আরসিসি ভবনের চেয়ে কম হবে।
স্টিল ফ্রেমের ওপর তৈরি ভবন ব্যয়বহুল বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু এ ভবনের বাইরের দেয়াল ও ভেতরের পার্টিশন সনাতনী ইটের দেয়ালের চেয়ে কম বলে ভবনের মোট খরচ আরসিসি ফ্রেমের পাকা ভবনের চেয়ে কম হবে। তা ছাড়া এ ভবন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো থাকছেই। ফলে নতুন জায়গায় নতুন স্কুল দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে চালু করা যাবে। অথচ আরসিসির ভবন হলে কম করে হলেও নতুন ভবন নির্মাণে তিন বছর লাগবে। সুতরাং এডুকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট (ইইডি) চরাঞ্চল ও নদীভাঙনের আশঙ্কা থাকা জায়গায় স্কুল নির্মাণে স্টিল ফ্রেম বিল্ডিং করার পলিসি দেরি হলেও এখন থেকে গ্রহণ করতে পারে।
ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ