ধর্ষণের শিকার নারী মানে অচ্ছুত নন
রাজধানীর বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশ যখন উত্তাল, ঠিক সেই সময় সিলেটের বিয়ানীবাজারে যে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটল, তাতে ভাষা হারিয়ে ফেলার জোগাড়। ঘটনাটি এমন: লন্ডনপ্রবাসী এক ব্যক্তি ধর্ষণের শিকার এক কিশোরীকে বিচার পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আবারও ধর্ষণ করেছেন। গণধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ওই কিশোরীর বাবা এলাকার প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ওই লন্ডনপ্রবাসীর কাছে সহায়তা চাইলে তিনি সহায়তার আশ্বাস দেন এবং নিজ বাড়িতে কিশোরী ও তার বাবা-মাকে আশ্রয় দেন। তিনি একদিকে কিশোরীর বাবা-মাকে ধর্ষকদের মামলাসহ আইনি পদক্ষেপ চালানোর পরামর্শ দেন, অন্যদিকে প্রতি রাতে কিশোরীকে ধর্ষণ করেন। তিনি শুধু একাই ধর্ষণ করেননি, কয়েকজন বন্ধুকেও আমন্ত্রণ করে আনেন কিশোরীকে ধর্ষণ করার জন্য। আর এ ঘটনা সবার কাছে ফাঁস হয়ে গেলে তিনি এ জন্য কিশোরীর মাকে দায়ী করে তাঁকে বেধড়ক মারধর করেন।
সহায়তার আশ্বাস দিয়ে এ কেমন আচরণ! কল্পনা করা যায় এ রকম ঘটনার কথা? কিন্তু বাস্তব কখনো কখনো কল্পনাকেও হার মানায়। এখানে বয়স, শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা কোনো বাধা নয়। একশ্রেণির পুরুষের লালিত ধারণা হলো, যে মেয়ে একবার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তিনি তাঁর ‘সতীত্ব’ থেকে শুরু করে সামাজিক মর্যাদা সবকিছুই হারিয়েছেন। যেহেতু ধর্ষণের শিকার নারী সবকিছু হারিয়েছেন, তাহলে আবার তাঁকে ধর্ষণ করাই যায়। এতে দোষের কিছু নেই!
বিয়ানীবাজারের লন্ডনপ্রবাসী ওই ব্যক্তি নিশ্চয়ই এমনটাই ভেবেছিলেন। শুধু তিনি কেন, অনেকেই তা-ই মনে করে। তারা মনে করে, একটি মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তিনি যেন অচ্ছুত, অস্পৃশ্য। তাঁর আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। তাঁর আর বারবনিতার মধ্যে তেমন কোনো তফাত নেই। এ রকম একটি ধারণা থেকেই সম্ভবত আমাদের সমাজে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার বিষয়টিকে উৎসাহিত করা হয়।
কোনো অবিবাহিতা মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন সমাজের কাছে তিনি অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। কে তাঁকে বিয়ে করবে? তখন সমাধান হচ্ছে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে। এভাবে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে সারা জীবন ধরে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পথ করে দেওয়া হয়। সমাজের এই মনোভাবের কারণেই ধর্ষণের শিকার হয়ে অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করছেন। আবার অনেক ধর্ষণের ঘটনাই চাপা পড়ে যাচ্ছে। ধর্ষণের শিকার মেয়ের পরিবার চায় না, তাদের মেয়ের ধর্ষণের কথা প্রকাশিত হোক। এতে করে যে সমাজে তাদের মানসম্মান বলতে কিছুই থাকবে না। সবার সামনে নাক কাটা যাবে। সমাজ তো বলবে, কেন তোমার মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলো। মেয়ে তো আমাদেরও আছে। একই কারণে ধর্ষণের শিকার অনেক নারী এ কথা গোপন রাখেন। ভাবতে বাধ্য হন, কী হবে ধর্ষকের বিচার চেয়ে? সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। সবাই জেনে গেলে মুখ দেখাব কী করে? ভালো বিয়ে হবে না। এ কারণে অনেক ধর্ষক জঘন্য অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। অনেক ধর্ষক সবাইকে বলে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে একই মেয়েকে বারবার ধর্ষণ করছে। ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে ধর্ষণের শিকার নারীকে ব্ল্যাকমেল করছে।
তাহলে মনে প্রশ্ন জাগে, আসল অপরাধী কে? ধর্ষক, না আমাদের সমাজের মনোভাব? এই মনোভাবের পরিবর্তন কবে হবে? কোনো দিন কি আদৌ হবে?
সবাইকে মনে রাখতে হবে, ধর্ষণ একটি ঘটনামাত্র। সে জন্য ধর্ষণের শিকার নারীকে অচ্ছুত মনে করা যাবে না। একবার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে সমাজে তাঁর মর্যাদা বারবনিতার মতো—এ রকম ভাবার কোনো অবকাশ নেই। ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। ধর্ষক, ধর্ষণের শিকার নারী, তাঁদের পরিবার, সবাইকে এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক