২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

টিকফা চুক্তি কেন নতুন শৃঙ্খল?

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা অনুযায়ী, বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তে যাওয়ার কথা নয়, কোনো চুক্তি স্বাক্ষরও করার কথা নয়, তবু ২৫ নভেম্বর এই নির্বাচনকালীন সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা বা ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। এটা এমন এক চুক্তি, যা দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে দীর্ঘ মেয়াদে আরও কঠিন শৃঙ্খল, আর্থিক ক্ষতি ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে যাবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ, চাপ ও খসড়া দিয়েই চুক্তিটি হচ্ছে, তবু বাণিজ্যমন্ত্রী, মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ কেউ কেউ আমাদের বিশ্বাস করতে বলেন, এতে নাকি বাংলাদেশেরই লাভ! প্রথম প্রশ্ন হলো, যে দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে প্রথম সারিতে, তারা কি তবে টিফা বা টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে? দ্বিতীয়ত, আর যারা চুক্তি করেছে, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা কী? তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র কেন এই চুক্তি স্বাক্ষরে এত আগ্রহী?

যুক্তরাষ্ট্রের যে ১০টি দেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য, সেগুলো হলো যথাক্রমে কানাডা, চীন, মেক্সিকো, জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, সৌদি আরব ও ফ্রান্স। তালিকায় ভারত ত্রয়োদশ। ভেনেজুয়েলা ও ইতালি এর পরে। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের টিফা চুক্তি আছে শুধু সৌদি আরবের সঙ্গে। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়েছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি।

আফ্রিকায় টিফা চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর অগ্রগণ্য নাইজেরিয়া। ২০০০ সালে তারা টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য পাথেয় হতে পারে। এ ছাড়া আছে ঘানা, অ্যাঙ্গোলা, রুয়ান্ডা। মধ্যপ্রাচ্যে বাহরাইন, মিসর, কুয়েত, ওমান, সৌদি আরব। এর বাইরে দক্ষিণ এশিয়ায় আছে আফগানিস্তান, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ভারতের সঙ্গে, তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো টিফা বা টিকফা চুক্তি নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে আছে এবং সেখানে নিয়মিত মার্কিন ড্রোন বোমা পড়ছে। এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য চীন ও জাপানের সঙ্গে, তাদের সঙ্গেও এই ধরনের চুক্তি নেই। সুতরাং বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য এই চুক্তি দরকার—এই যুক্তি ধোপে টেকে না।

আর যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বেশি ও তার সঙ্গে বাণিজ্য বেশি থাকা মানেই কি তা জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে? এটা নির্ভর করে, কী শর্তে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ হচ্ছে, তার ওপর। চুক্তি আছে, এ রকম দুটো দেশ নাইজেরিয়া ও সৌদি আরব—দুটোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। এই দুটো থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তেল আমদানিকারকদের শীর্ষে। নাইজেরিয়া তেল ও গ্যাস সম্পদে আফ্রিকার অন্যতম শীর্ষস্থানীয়। সেখানে মার্কিন বিনিয়োগ এখন প্রায় ৫০০ কোটি ডলার, পুরোটাই খনিজ সম্পদে। এই কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রে নাইজেরিয়ার তেল রপ্তানি হয়, যার পরিমাণ বার্ষিক তিন হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এ দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ও তেল রপ্তানি চলছে বহু বছর ধরে। নাইজেরিয়ার জন্য পরিণতি হলো, সেখানে শিক্ষা ও চিকিত্সা খাতে ব্যয়ের জন্য রাষ্ট্রের অর্থ নেই, লোডশেডিং এখনো বড় সমস্যা। সম্পদ ও বিদেশি বিনিয়োগ বহু গুণ বেশি, কিন্তু দারিদ্র্যের হার এখন বাংলাদেশের দ্বিগুণ।


যুুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫৯তম। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ রপ্তানির তুলনায় প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ, মাত্র ৫০ কোটি ডলার। রপ্তানি ৪৯০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় সুতা, কাপড়, যন্ত্রপাতি, স্টিল, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, কিছু গমসহ খাদ্যশস্য। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যায় প্রধানত তৈরি পোশাক। এর বাইরে সিরামিকসহ কিছু সামগ্রী। আমদানি পণ্যগুলোর বেশির ভাগ গার্মেন্টস রপ্তানির সঙ্গে সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের অস্ত্র ছাড়া আমদানি বাড়ানোর সুযোগ খুবই কম। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ অনেক। তৈরি পোশাক রপ্তানিই আরও অনেক বাড়ানো সম্ভব। এ ছাড়া খাদ্যশস্যসহ আরও অনেক পণ্য রপ্তানি সম্ভব। কিন্তু তার পথে বাধা কী? বাধা যুক্তরাষ্ট্র নিজেই।

প্রতিষ্ঠিত ধারণা হলো, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অর্থ দেয়, খাদ্য দেয়, নানা রকম সুবিধা দেয়। নইলে বাংলাদেশ ডুবে মরত। তাই তার কথা অমান্য করা যাবে না। কিন্তু সত্য বরং বিপরীত। যুক্তরাষ্ট্রে গড় আমদানি শুল্কহার যেখানে শতকরা ১ ভাগের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ, কোনো কোনো পণ্যে আরও বেশি। গত এক বছরে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির শতকরা প্রায় ২৩ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। এ হিসাবে গত বছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক বাবদ প্রদান করেছে কমপক্ষে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়েক বছর আগে পর্যন্ত যে ঋণ অনুদান বাংলাদেশে আসত, এটি তার ছয় গুণেরও বেশি, এখন তা আরও অনেক গুণ বেশি। অর্থাত্ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের জোগান দিচ্ছে প্রতিবছর!

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিয়ে একটা কৃত্রিম হাহাকার ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প কোনো জিএসপি সুবিধা কখনো পায়নি। বরং বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনেক রকম বৈষম্যের শিকার। তারাই ‘মুক্তবাজার নীতিমালা’ ভঙ্গ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ করে রেখেছে! সে জন্য বিশেষ সুবিধা বা অনুগ্রহের দরকার নেই। যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের পণ্যের ওপর অন্যান্যদেশের অনুপাতেই শুল্ক আরোপ করে; তাহলেই বাংলাদেশের প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ কমে এবং সেটা গার্মেন্টস খাতে। বাণিজ্য সম্প্রসারণই লক্ষ্য হলে শুল্কহার গড় মানে নামিয়ে আনলেই চলে!


আরও প্রশ্ন হলো, বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থায় যেখানে বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ (ডব্লিউটিও) আছে, সেখানে এই বিশ্বব্যবস্থারই সরদার যুক্তরাষ্ট্র কেন আলাদা করে চুক্তি করতে চায়? কারণ, দুর্বল দেশের, বিশেষ করে যেসব দেশের শাসকেরা গলা বাড়িয়ে ফাঁস পরতে উন্মুখ, তাঁদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হলে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের বাইরে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খল বিস্তার খুব সহজ। শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক-সামরিক আধিপত্যেও এটা খুব কার্যকর।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশে মেধাস্বত্বাধিকার প্রয়োগের চাপ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছাড় পেয়েছে। ওষুধশিল্প তারই সুবিধাভোগী, কম্পিউটার ও আইটির বিস্তারও আন্তর্জাতিক এই যৌক্তিক বিধিমালার কারণেই ঘটতে পেরেছে। এখন টিকফা স্বাক্ষরিত হলে আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত ছাড় গুঁড়িয়ে দিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চেপে বসতে পারবে। এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওষুধশিল্প এবং আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। জনগণের জন্য ফলাফল—এসব ক্ষেত্রের সবকিছুর দাম অনেক বাড়বে। এ ছাড়া কৃষিক্ষেত্রেও বহুবিধ বিপদের আশঙ্কা। বাংলাদেশ জানে না, কত কত বীজ, ফসল, গাছ, ফল, ফুল মেধাস্বত্ব জালে কোন কোন কোম্পানির মালিকানায় চলে গেছে। সেই জাল টানতেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য টিকফা জরুরি।

মার্কিন বিনিয়োগ বাড়লেই বাংলাদেশের স্বার্থ নিশ্চিত হবে? বাংলাদেশে গ্যাস খাতে মার্কিন কোম্পানির বিনিয়োগ আছে। শেভরনের কাছ থেকে কয়েক বছরে যে পরিমাণ গ্যাস ১৬ হাজার কোটি টাকায় কিনতে হয়েছে, তা দেশীয় সংস্থার মাধ্যমে করালে দুই হাজার কোটি টাকায় পাওয়া সম্ভব ছিল। সমুদ্রে এক হাজার কোটি টাকা পাঁচ বছরে বিনিয়োগ করছে আরেক মার্কিন কোম্পানি কনকোফিলিপস। এর বদলে দুই ব্লকের গ্যাস সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগের কর্তৃত্ব তাদের হাতে, রপ্তানির অধিকারও তাদের। বঙ্গোপসাগরের আরও গ্যাস ব্লক কনকোফিলিপসকে দেওয়ার আয়োজন এখন সম্পন্ন। এ জন্য কদিন আগেই পিএসসি ২০১২ সংশোধন করে তাদের জন্য সুবিধা আগের চেয়েও অনেক বাড়ানো হয়েছে। এখান থেকে প্রাপ্ত গ্যাস তাদের কাছ থেকে কেনার দাম বাড়ানো হয়েছে, তাদের ইচ্ছামতো দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের নিজের গ্যাস কিনতে যা খরচ পড়বে, তার তুলনায় অন্য দেশের কাছ থেকে গ্যাস আমদানি করাই বেশি লাভজনক হবে!

তাহলে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের উন্নতির অর্থ কী? বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চরম বৈষম্যমূলক ও সংরক্ষণবাদী শুল্কনীতি কি যুক্তরাষ্ট্র পরিবর্তন করবে? অসম বিনিয়োগ চুক্তি কি সংশোধন বা বাতিল হবে? শেভরনের কাছে মাগুরছড়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকা কি শোধ করবে তারা? সব সামরিক-বেসামরিক চুক্তি কি জনগণের কাছে প্রকাশ করবে? না, কোনো সম্ভাবনা নেই।

সামনে নির্বাচন। নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রধান দুই পক্ষই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগরসহ সমগ্র দেশ এই প্রতিযোগিতার বলি। জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে সরকার যখন এক পা আগায়, তখন বিরোধী পক্ষ সে বিষয়ে গভীর নীরবতা অবলম্বন করে, বরং পেছনে আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার জন্য ধরনা দেয়। বাংলাদেশকে যে রাজনীতি নিলামে তোলে, জনগণ সেই রাজনীতির শৃঙ্খলে এখনো আটকে থাকায় বহুবিধ দাসত্বের বোঝা তাদের মাথায় চাপছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের এমনই মহিমা যে কোনো নির্বাচিত সংস্থা এসব চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনা করে না।

জনগণের সম্মতি ছাড়া তাদের নামে কোনো সরকারেরই টিকফা নামের এই দাসত্বের চুক্তি স্বাক্ষরের নৈতিক অধিকার নেই। নির্বাচনকালীন সরকারের আইনি অধিকারও নেই। অতএব, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তা হবে জাতীয় স্বার্থবিরোধী আরেকটি দলিল, অনৈতিক ও অবৈধ। অতএব, তা মান্য করার কোনো বাধ্যবাধকতা জনগণের নেই।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।