‘চলো, আজ তোমাকে আমার অফিসে নিয়ে যাব।’
আব্বার এই ঘোষণা শুনে মনটা খুশিতে নেচে উঠেছিল। বহুবার আবদারের পর আব্বা রাজি হয়েছিলেন। তখন আমার বয়স কত হবে, সাত কিংবা আট। আব্বা রোজ রোজ কোথায় কাজ করতে যান, আমার সেটা দেখার ভীষণ খায়েশ। বড় বোনেরা আমাকে সাদা হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট পরিয়ে গ্যালেজ লাগিয়ে দিল। মাথায় তেলটেল দিয়ে টেরি কেটে বাবু বানিয়ে দিল রীতিমতো। সাদা মোজা আর নটিবয় শু তো ছিলই।
রিকশায় চড়ে গেলাম আব্বার দপ্তরে। বিরাট সে লাল রঙের বিল্ডিং। তারই দোতলার এক ঘরে আরও অনেকের মাঝে একটি টেবিল–চেয়ার আব্বার একান্ত কার্যক্ষেত্র। তিনি সেখানকার ‘ছোটবাবু’। ঘণ্টাখানেক ভালোই কেটেছিল আব্বার টেবিলের এটা–ওটা নেড়েচেড়ে। তারপরই শুরু হলো যন্ত্রণা। পেটে ভীষণ চাপ অনুভব করলাম। প্রকৃতির ডাক। বলতে লজ্জা পাচ্ছি, সহ্যও করতে পারছি না। ছটফট করে বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরলাম। আব্বা তখন কাজে ব্যস্ত। একসময় বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন। ব্যস, শুরু হলো কান্না। শেষমেশ না পেরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আব্বা পিয়ন দিয়ে বাড়ি পাঠালেন আমাকে।
ওই প্রথম আর শেষ, ওই লাল ভবনে যাওয়া। কিন্তু কতবার যে ওর আশপাশ দিয়ে ঘুরেছি, তার ইয়ত্তা নেই। চমৎকার একটি পরিবেশে চমৎকার একটি ভবন। সবুজের সমারোহে লালের খেলা। ভবনটির নাম সিআরবি। যে এলাকাকে আমরা বলি চট্টগ্রামের ফুসফুস। সিআরবি অর্থাৎ সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণের পর ব্রিটিশরাজ সেখানে যত ভবন নির্মাণ করেছিল, তার মধ্যে পুরোনো ও স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নান্দনিক নিদর্শন এই সিআরবি। কালের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে এখানে অসাধারণ এক নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। শত শত চেনা-অচেনা বৃক্ষের সমাহার ও নানা রঙের ফুলের মনভোলানো গন্ধে এক অপূর্ব আবহ সৃষ্টি করেছে, যা পথচারীকে মুহূর্তের জন্য হলেও এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে আপ্লুত করবেই। সব ঋতুতেই এই সিআরবি এলাকায় আজকাল হাজারো মানুষ একবারের জন্য হলেও ঘুরে আসে, শুধু এর সৌন্দর্যসুধা পান করার জন্য। আর এখন তো প্রতিবছর নানা জাতীয় দিবস উপলক্ষে বসে বিচিত্র মনের মানুষের মিলনমেলা।
আব্বা রেলওয়েতে চাকরি করতেন এবং ১৯৪৪ সাল থেকে তাঁর পোস্টিং ছিল ওই সিআরবিতে। ওটা তখন আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ছিল বোধ করি। পরে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ের প্রধান অফিস হয়। আর আব্বার চাকরির অছিলাতেই ২২টি বছর বাস করেছি বিখ্যাত বাটালি পাহাড়ের কোলে টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনিতে। কত স্মৃতি ভাসছে এখনো হৃদয়ে!
এরই মধ্যে খবর এল ৫০০ বেডের হাসপাতাল হবে ওই এলাকায় কয়েক শ ঐতিহাসিক বৃক্ষ নিধন করে। মনটা ভীষণ ক্ষুব্ধ ওই সংবাদে। শুধু আমি কেন, চট্টগ্রামবাসীও ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ এবং তাঁরা এখন এই বৃক্ষ নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। সব বিবেকবান ও পরিবেশসচেতন ব্যক্তি এই আন্দোলনের পক্ষেই মত দেবেন।
চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। পাহাড়, জঙ্গল, নদী ও সমুদ্রঘেরা একটি শহর। বার আউলিয়ার পদধূলিতে ধন্য পবিত্র শহর। সবই সুন্দর ও ভালো লাগার মতো। উঁচু-নিচু টিলায় ভরা পাহাড়তলী থেকে স্টেশন এলাকা বড়ই মনোমুগ্ধকর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পথঘাট, সুন্দর সুন্দর কোয়ার্টার, বাংলো, খেলার মাঠ, এমপ্লয়িজ ক্লাব, স্কুল—কী নেই সেখানে। আর সিআরবি–সংলগ্ন নিচু টিলায় রেলওয়ে হাসপাতাল, যার সবকিছুই সাহেবি কায়দায় চলত তখন। পাশেই হাসপাতাল কলোনি। চমৎকার, অসাধারণ, মনকাড়া সবকিছুই। এই হাসপাতাল কলোনিতে ঢোকার মুখে রাস্তায় সিআরবির মোড়ে দাঁড়িয়ে ১৯৬১ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে দেখেছিলাম, এখনো মনে পড়ে। সঙ্গে বোধ করি গভর্নর আযম খান ছিলেন গাড়িতে। সিআরবির এই স্মৃতিও ভোলার নয়। কতক্ষণ যে অপেক্ষায় ছিলাম সেদিন ওখানটায়!
সময়ে–অসময়ে পোলো গ্রাউন্ডের উঁচু-নিচু রাস্তায় প্রতিযোগিতা করে প্রায়ই সাইকেল নিয়ে সিআরবি এলাকা ঘুরে আসতে আনন্দ পেতাম ভীষণ। বর্ষায় চেনা-অচেনা গাছগুলোয় যখন ফুল ফুটত, আরেক অপরূপ চেহারা সিআরবির। আজ, এখনো চট্টগ্রাম গেলে একবার হলেও সিআরবি ঘুরে আসি, যেকোনো ছলে! আমি যে নিজেকে এখনো মনে করি রেলের লোক! কিন্তু ছোটবেলার সেই ঘটনার পর ওই ভবনে আর যাওয়া হয়নি কোনো দিন। তবে কিছুদিন থেকে একটা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, একবার যেতে হবে ওই ভবনটায়। না, ঠিক দেখতে নয়, অন্য কাজে। ১৯৭৮ সালে লিবিয়া যাওয়ার সময় বাড়ির সব জিনিসপত্র বিলিব্যবস্থা করে যাওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে বাবার সব স্মৃতিও হাতছাড়া হয়। তাঁর ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট ও হাতের লেখা চিঠিগুলো আর পাইনি। সার্টিফিকেটের কপি আর হাতের লেখার নমুনা সংগ্রহে পারসোনেল শাখায় আমার একবার যাওয়ার খুব ইচ্ছা বেশ কিছুদিন থেকে।
এরই মধ্যে খবর এল ৫০০ বেডের হাসপাতাল হবে ওই এলাকায় কয়েক শ ঐতিহাসিক বৃক্ষ নিধন করে। মনটা ভীষণ ক্ষুব্ধ ওই সংবাদে। শুধু আমি কেন, চট্টগ্রামবাসীও ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ এবং তাঁরা এখন এই বৃক্ষ নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। সব বিবেকবান ও পরিবেশসচেতন ব্যক্তি এই আন্দোলনের পক্ষেই মত দেবেন। তাঁরা কিছুতেই চট্টগ্রামের ফুসফুসকে ধ্বংস করতে দেবেন না। আমিও তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, ঐতিহ্যের ভিত ধরে নাড়া দেবেন না। নিজেরা নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করুন, নইলে আপনাদের স্থান হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
আমি ভালোবাসি চট্টগ্রামকে। আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রারম্ভকাল কেটেছে এখানকার আলো, বাতাস, মাটি আর আকাশে। আমি ভালোবাসি রেলকে। কারণ, বাবা চাকরি করতেন রেলে। এখানেই আমার বেড়ে ওঠা। আমি ভালোবাসি সিআরবিকে। কারণ, এখানে বাবার ২৪ বছরের হাজারো স্মৃতি বিদ্যমান, তাঁর হাতে লেখা ফাইলের নোটশিট আর ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটের কপি। আমি ভালোবাসি সিআরবির নিসর্গকে। কারণ, ওটা আমার প্রিয় চট্টলার ফুসফুস, যেখানে বছরকে বছর বিচরণ করেছেন আমার আব্বা ও তাঁর মতো লাখো রেলকর্মী। আজও বিচরণ করছেন অজস্র প্রকৃতিপ্রেমী। ওদের ভালোবাসার কি কোনো মূল্য নেই? সব ভেঙে তছনছ করতেই হবে! আমি ও আমার মতো রেল–পরিবারের মানুষগুলো যে সিআরবির নিসর্গের সঙ্গে নাড়ির টান অনুভব করি, তাকে খেয়ালখুশি মতো হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেলতে হবে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে! কেন? কেন?
ধিক আপনাদের, ধিক।
মনে রাখবেন, ধ্বংসকারীর বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।
আবুল হায়াত অভিনেতা