২০০৮ সালের প্রথম দিকের কথা। খাগড়াছড়ি থেকে জনা পাঁচেক কলেজশিক্ষক আমার চেম্বারে এলেন। তাঁরা কাগজপত্র দেখালেন বছর দশেক আগের: ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় থাকবে। সেই সময়ে সরকারি হিসাবে, যতদূর মনে পড়ে ৬৪ জেলার মধ্যে ৪১টি জেলায় অন্তত একটি করে সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় ছিল। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিল অবশিষ্ট ২৪টি জেলায় সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। সেই প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়িতে কলেজের জন্য প্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ এবং আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন হয়ে যায় ২০০৩ সাল নাগাদ। অনানুষ্ঠানিক ও বেসরকারিভাবে মেয়েদের কলেজ হিসেবে ছাত্রী ভর্তি এবং পড়াশোনার কাজও শুরু হয়ে যায়। সরকারীকরণের পর ছাত্রীদের জন্য পড়াশোনার সরঞ্জামাদি, লাইব্রেরি, খেলাধুলাসহ অন্যান্য ব্যাপারেও সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। আপাতত কলেজটি চলছিল স্থানীয় কিছু অনুদান ও অন্যান্য জোড়াতালির ব্যবস্থার মাধ্যমে।
শিক্ষকেরা চাচ্ছিলেন একটা রিট মামলা করে সরকারের ওপর কোর্টের নির্দেশ জারি করাতে, যাতে সরকারীকরণ-প্রক্রিয়াটা দ্রুত নিষ্পন্ন হয়। তাঁরা জানালেন, সরকারের ওই প্রকল্পের আওতায় ৬১টি জেলায় অন্তত একটি করে সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে। বাকি শুধু তিনটি পার্বত্য জেলা। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে একটিও সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় নেই, এমন জেলা ছিল শুধু তিনটি—খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান।
বলা বাহুল্য, সরকারি কলেজে পড়াশোনা করার সুযোগ-সুবিধা ও সেই সঙ্গে পড়াশোনায় ভালো হওয়ার চান্স অনেক বেশি। ভাঙাচোরা বেসরকারি কলেজে অল্প সুবিধা ও স্বল্প শিক্ষকদের চেয়ে সরকারি কলেজে পড়াশোনা করতে পারলে বিদ্যা অর্জন তুলনামূলকভাবে হয় অনেক ভালো। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ও সরকারি বা অন্য কোনো ভালো চাকরি পাওয়ার সুযোগও অনেক বাড়ে। কিন্তু কোনো জেলায় বা এলাকায় যদি সরকারি মহাবিদ্যালয় না থাকে, তাহলে ওই এলাকার ছাত্রী হলে অল্প বয়সেই বিদ্যা অর্জনের সুযোগ ও সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে হয়ে পড়বে অত্যন্ত সীমিত। পার্বত্য এলাকায় যেনতেন একটা বেসরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে পাস করে ঢাকার ইডেন (সরকারি স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ১৮৭৮; সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ হিসেবে ১৯৫৮; বর্তমানে প্রায় ১৮ একর জমি, ২৫ হাজারের বেশি ছাত্রী ও দুই শতাধিক শিক্ষক) বা বদরুন্নেসা (স্থাপিত ১৯৬২) কলেজের ছাত্রীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ঢাকা বা অন্য অনেক বড় শহরের মেয়েরা পড়াশোনা করার জন্য বহু বছর ধরে যেসব সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে, সেই সুযোগ-সুবিধা থেকে এই দেশেই জন্মগ্রহণ করা প্রত্যন্ত এবং পার্বত্য অঞ্চলের মেয়েরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত। অন্য কথায়, রাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে তাদের প্রতি অন্যায় করেছে। প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে ঐতিহাসিক অন্যায়টাকে স্বীকার করে নেওয়া এবং সেই অন্যায়ের প্রতিকার করা বা খুব সাদামাটা ভাষায় পুষিয়ে দেওয়ার জন্য কোটাব্যবস্থা।
বয়স্ক আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে শুনেছি যে সিলেট থেকে ১৯৫০ বা ১৯৬০-এর দশকে ইংল্যান্ডে গিয়ে যখন বাড়ি ভাড়ার খোঁজে বেরোতেন, তখন বাড়ির সামনে ‘টু লেট’-এর নিচে লেখা থাকত ‘নট ফর এশিয়ানস’। ভালো এলাকায় বাড়ি না পেয়ে ভাড়া নিতে হতো তুলনামূলকভাবে শহরের বাইরে, সুযোগ-সুবিধাবিহীন এলাকায়। ছেলেমেয়েরা পড়তে যেত ওই সব এলাকার যেনতেন স্কুলে। এমনকি সত্তরের দশকেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে না ভেবে ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় প্রজন্মেও তত দিনে ব্রিটিশ নাগরিক (সিলেট থেকে যাওয়া) ছেলেমেয়েরা স্কুল পাস করার পর কোথাও ভর্তির চেষ্টাও করত না। কোটা না থাকায় চেষ্টা করলেও সম্ভবত ভালো সরকারি স্কুলে পড়ুয়া সাদা চামড়ার ব্রিটিশদের সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে চিতপটাং হতো। ১৯৮০-এর শেষে, ১৯৯০-এর প্রথমে লন্ডনে যখন পিএইচডির জন্য পড়াশোনা করছিলাম, তখন সেই প্রতিষ্ঠানে একজনও ব্রিটিশ-বাঙালি ছাত্রছাত্রী ছিল না।
ভারতে অস্পৃশ্যতাজনিত কারণে নিম্নবর্ণের লোকদের উচ্চশিক্ষার রাস্তা ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। ভারত, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বহু দেশে এই গোছের ঐতিহাসিক অন্যায় প্রতিকার হিসেবেই ‘Reservation’, ‘Affirmative Action’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে কোটা সিস্টেম চালু আছে। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ব্যবসায়ও—যেমন সরকারের রাস্তাঘাট বানানোর কাজের এক-দশমাংশ দিতে হবে অশ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীদের। অবশ্য বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে চাকরিতে, ব্যবসায়, ভর্তিতে এই Affirmative Action–এর হিসাব অনেক জটিল। ভারতের হাইকোর্টের সুপ্রিম কোর্টে রিজারভেশনের আওতায় কে কোথায় ভর্তি হতে পারবে বা কী চাকরি পাবে, তা নিয়ে মামলা হয়েছে শত শত। কোটা আন্দোলনের কারণে এমনকি ভারতেও সরকারকে গদি ছাড়তে হয়েছে।
২.
পাঁচ শিক্ষকের কথায় ফিরে যাই। মামলা করা যেত, কিন্তু তখনকার সরকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানকে ফোন করলাম। বেশ পরিচিত আর ব্যাপারটা তদবিরের পর্যায়ে পড়ে না। বললাম, তিন পার্বত্য জেলায় এখনো একটিও সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় নেই। ব্যাপারটা খুলে বললাম। তিনি আশ্বস্ত করলেন, দেখব। তিন-চার মাস পরে পত্রিকায় ছোট খবর পড়েছিলাম, পার্বত্য জেলাগুলোতে সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে। অতএব পার্বত্য এলাকা, সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং এলাকার জন্য কোটা অবশ্যই থাকতে হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮ (৪)-এ বলা আছে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য’ সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নেবে। সংবিধান পক্ষান্তরে স্বীকার করছে যে নারী, শিশু ও অনগ্রসর অংশকে ঐতিহাসিকভাবে সমান সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে ঐতিহাসিকভাবে অন্যায় করা হয়েছে। সেই অন্যায়ের প্রতিকার হিসেবে বা এখন তাদের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।
শিশুদের জন্য চাকরির ব্যাপারটা আসে না। নারী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন কারণে সমান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এলাকা—যেমন হাওর, চর, দ্বীপ, পাহাড়ি এলাকার জন্য হিসাব-নিকাশ করে কোটার ব্যবস্থা রাখতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা তাদের কোনো অংশ ঐতিহাসিকভাবে সমান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকলে, তাদের দিকেও নজর দিতে হবে।
৩.
মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার ব্যাপারে আদালতের একটা রায়ের কথা বলা হচ্ছে, রায়টা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স নিয়ে; মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে নয়। অতএব সেই রায়ে মুক্তিযোদ্ধার কোটা সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো ‘Obiter Dictum’ বা পর্যবেক্ষণগুলো আমাদের মতে সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে ‘ঘোষিত আইন’-এর আওতায় পড়ে না। তা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার ওপরে উল্লিখিত ২৮ অনুচ্ছেদে ‘অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য’ এর আওতায় পড়ে কি না, সেটা নির্ধারণের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের উপদেশ চাইতে পারেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার ব্যাপারে কী করণীয়, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ৪৭ বছর পর, সেটা নিঃসন্দেহে একটা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ধরনের বিশেষ জনগুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে আপিল বিভাগে উপদেশের জন্যই ১০৬ অনুচ্ছেদের বিধান। এই বিধানের অধীনে অতীতে রাষ্ট্রপতি দুবার আপিল বিভাগের উপদেশ চেয়েছিলেন এবং পেয়েছিলেন।
শেষ কথা হলো, ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার হিসেবে কোটাব্যবস্থা থাকতেই হবে। শূন্য কোটা অসাংবিধানিক সমাধান। হিসাব-নিকাশ করে সংস্কার করতে হবে। আর আপিল বিভাগের উপদেশের আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। বহু দেশেই বহুবার কোটা নিয়ে দাবিদাওয়া, আন্দোলন, প্রতিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। কখনো সংস্কার হয়েছে, কখনো হয়নি। আমাদের দেশেই কোটা সংস্কারের দাবি পরিণত হয়েছে বিশেষ ‘অপরাধে’। মারধর, তুলে নিয়ে যাওয়া, মামলা-রিমান্ড-জেল এবং কোটা আন্দোলনকে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রদ্রোহসহ আরও কত কিছু বলা হচ্ছে। সরকার যেন দেশে গণতন্ত্রের অবশিষ্টাংশ রাখব না—এটা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর।
ড. শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক