এ দেশে দল ক্ষমতায় থাকলে দলের নাম ব্যবহার করে অনেকেই পথে-বেপথে নানা রকম সুবিধা নেওয়ার জন্য ‘দোকান’ খুলে বসেন। শিশু লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, পর্যটন লীগ, তৃণমূল লীগ ইত্যাদি নামে শ’খানেক নতুন ‘আওয়ামী দোকান’–এর নাম পত্রিকায় পেয়েছি আমরা। কিন্তু কিছুদিন আগে প্রথম আলোর ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসপি লীগের দাপট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন অতীতের সব নজির ভেঙে দিয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, পুলিশের কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম একটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এতটা সরাসরি জড়ান যে তাঁর একটি গ্রুপ আছে, যেটি ‘এসপি লীগ’ নামে পরিচিত। স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব এখন এতটাই যে তাঁর দুই ভাইকে উপজেলা আর পৌর চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এ ছাড়া মূল দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ তাঁর অনুসারীদের দখলে। সেই পুলিশ কর্মকর্তা নিজেই নিজেকে ‘দলপাগল’ বলে দাবি করেন। তিনি দলের প্রতি এতটাই আত্মনিবেদিত যে নিজের সরকারি অফিসকক্ষে প্রতিদিন অন্তত ৫০ জন নেতা-কর্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ দেশে অনেক আমলার সরকারি দলের প্রতি সহানুভূতি নতুন কিছু নয়। কিন্তু সরকারি অফিসে বসে সরাসরি স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ, নিজস্ব বলয় তৈরি, নিজের পদের সঙ্গে লীগে যুক্ত হয়ে এলাকায় পরিচিতি পাওয়া একেবারেই ভিন্ন একটি বিষয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই দিনের পর দিন এ ধরনের কাণ্ড চালিয়ে গেছেন তিনি। কারণ, তিনি জানেন, বর্তমান বাংলাদেশে এ ঘটনা তিরস্কারের বদলে পুরস্কার নিয়ে আসবে।
এসপি সাহেব খুব কাছ থেকে দেখেছেন গত কয়েক বছরে ক্ষমতার শীর্ষে আছেন প্রশাসন আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাঁরা যা খুশি করতে পারেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের জবাবদিহি করার কোনো বালাই নেই। এর আগে কুড়িগ্রামে কাবিখার টাকায় পুকুর সংস্কার করে সেটা ডিসির নিজের নামে নামকরণ করার চেষ্টা, এক সাংবাদিকের ফাঁস করে দেওয়া এবং তারপর সাংবাদিককে জেলা প্রশাসন ভবনে তুলে এনে নির্যাতন এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের শাস্তি দেওয়া নিয়ে তোলপাড়ের ঘটনা আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। এরপর চাপে পড়ে ঘটনাটির বিভাগীয় তদন্ত হয় এবং তাতে ডিসি সুলতানা পারভিন, আরডিসি নাজিম উদ্দিনসহ কয়েকজনের বিভাগীয় শাস্তি হয়। আমরা অনেকেই জানি, পরে রাষ্ট্রপতির কাছে শাস্তি মওকুফের আবেদন করেন তাঁরা এবং ডিসি, আরডিসির আবেদন মঞ্জুর হয়। অর্থাৎ উভয়ের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাকুক, এমনকি ন্যূনতম বিভাগীয় শাস্তিও বহাল রাখা যায়নি।
কয়েক দিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে জানা গেল, সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে পদায়নের পর থেকেই অধস্তন ও এলাকাবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছেন নাজিম উদ্দিন। ঘুষ–বাণিজ্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ, ক্রসফায়ারের হুমকি, নির্বাহী কোর্ট বসিয়ে জেল-জরিমানার হুমকি, চাকরি থেকে অব্যাহতির হুমকি, এমনকি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে মাদক সেবন ও বহনের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। আছে পৌর মেয়রকে অপসারণের চক্রান্তের অভিযোগ। এসব করতে তিনি পারেন, কারণ চাকরিজীবনের শুরুতেই নাজিম উদ্দিন বুঝে গেছেন, যতই অভিযোগ থাকুক না কেন, ন্যূনতম বিভাগীয় ব্যবস্থা বা শাস্তির মুখোমুখি হবেন না তিনি।
বর্তমান সরকারের নিজস্ব সনদ ছাড়া কোনো স্বীকৃত বৈশ্বিক সংস্থার বিবেচনায় বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক দেশ নেই। বাংলাদেশকে আধা স্বৈরতান্ত্রিক (হাইব্রিড রেজিম) শাসন বলেও উল্লেখ করেছে ইআইইউ। বাস্তবে বাংলাদেশে কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা চলছে, সেই তর্ক সরিয়ে রেখে বলা যায়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যতটুকু ছিটেফোঁটাও ছিল, সেটাও ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে।
কেবল আমলা নয়, ক্ষমতাসীন দলের সাংসদেরও দাপট দেখি নিয়মিত। কিছুদিন আগে যশোর জেলা প্রশাসনের ইফতার অনুষ্ঠানে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ শাহীন চাকলাদারের বাগ্বিতণ্ডার খবর প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতেই। কেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জামিন পাননি, এমপি প্রকাশ্যে সরাসরি সিনিয়র জেলা এবং দায়রা জজকে এমন প্রশ্ন করার সূত্রে সমস্যার শুরু। এ ধরনের প্রশ্ন কোনো বিচারককে কেউ করতে পারেন কি না, সেটা ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষও জানে। সেখানে একজন আইনপ্রণেতার জনসমক্ষে এ ধরনের আচরণ পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়, এ দেশে ক্ষমতাই হচ্ছে প্রথম ও শেষ কথা।
যতই আমরা সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিংবা রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের পৃথক্করণ নিয়ে আলাপ করি না কেন, যে দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাই সবকিছুর চূড়ান্ত নির্ণায়ক, সেখানে এসব বিষয় কথার কথা হিসেবেই থাকবে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গণতন্ত্রের সূচক আমাদের দেশে বেশ পরিচিত। বাংলাদেশ এতে আধা স্বৈরতন্ত্রের (হাইব্রিড রেজিম) তকমাপ্রাপ্ত। এই সূচকে সব সময় সর্বোচ্চ ভালো অবস্থানে (পূর্ণ গণতন্ত্র) থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে নেমে যায় দ্বিতীয় ধাপ, অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে। কেন এমন হয়েছিল তাঁর সময়?
বিশ্বব্যাপী খুবই আলোচিত হাউ ডেমোক্রেসিস ডাই গ্রন্থে লেখকদ্বয় বলতে চেয়েছেন, কিছু ব্যতিক্রম বাদে বর্তমান পৃথিবীতে আগের মতো এক রাতে হঠাৎ করে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার চালু হয়ে যায় না। এখন বরং একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ধীরে ধীরে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। তাঁরা বেশ কয়েকটি কেস স্টাডির মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের গণতন্ত্র ক্ষয়কারী পদক্ষেপ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁরা বলেন, যেসব শাসক উদার গণতন্ত্রকে দুর্বল করে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে চান, তাঁরা কখনো আইনের চৌহদ্দির মধ্যে, আবার কখনো আইন ভেঙে পদক্ষেপ নেন। বিকশিত গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকেরা অনেক সময়ই এসব বিষয়কে ব্যতিক্রমী, সাময়িক স্খলন বলে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেন না। কিন্তু এই চর্চাই ক্রমাগত চলতে চলতে একসময় ভেঙে ফেলে উদার গণতান্ত্রিক কাঠামোটিকে।
বর্তমান সরকারের নিজস্ব সনদ ছাড়া কোনো স্বীকৃত বৈশ্বিক সংস্থার বিবেচনায় বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক দেশ নেই। বাংলাদেশকে আধা স্বৈরতান্ত্রিক (হাইব্রিড রেজিম) শাসন বলেও উল্লেখ করেছে ইআইইউ। বাস্তবে বাংলাদেশে কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা চলছে, সেই তর্ক সরিয়ে রেখে বলা যায়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যতটুকু ছিটেফোঁটাও ছিল, সেটাও ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বলেই শুরুর ঘটনা তিনটি আলোচনা করলাম। কিন্তু এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে একেবারে নিয়মিত বিরতিতে। এমন সব ঘটনাই ভেঙে ফেলছে গণতন্ত্রের শেষ কাঠামোটুকু; আগের চেয়ে আরও বেশি স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব আমরা দেখছি সরকারের ভেতরে। এসব ঘটনায় আমরা, নাগরিকেরা বেশির ভাগই আর কিছু বলি না, কেউ কেউ হয়তো ক্ষোভ-উষ্মা প্রকাশ করি। কিন্তু রাষ্ট্রের ‘স্বাধীন’ অঙ্গ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যায় একেবারেই নিশ্চুপ।
রুমিন ফারহানা বিএনপির সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী