শোকের মাস আগস্ট শেষ হয়েছে। কিন্তু আগস্টের বিতর্ক শেষ হয়নি। বিতর্ক চলেছে জাতীয় সংসদে, সংসদের বাইরে। দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিতর্ক করতে সশরীর সবাইকে মঞ্চে বা টক শোতে হাজির হতে হয় না; স্ট্রিম ইয়ার্ড, জুম, ওয়েবিনারে যুক্ত হলেই হলো।
দুই-তিন সপ্তাহ ধরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাদের বিতর্কের ধরনধারণ দেখে মনে হয়নি সত্যানুসন্ধান এর উদ্দেশ্য ছিল। ২০২৩ সালের নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কে কত উৎকটভাবে ঘায়েল করতে পারে, সেই চেষ্টাই চলছে।
প্রচারের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যে বাড়তি সুবিধা ছিল, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কারণে তা অনেকটা খর্ব হয়েছে। এখন মানুষ আর সরকারি প্রচারযন্ত্র কিংবা মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে না; ফেসবুক, ইউটিউব, অনলাইন ইত্যাদি ব্যবহার করে তারা নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা শুনতে পারে। প্রয়োজনে নিজের মতও জানাতে পারে। সরকার না চাইলেও হাজারো তথ্য-বক্তব্য (টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ইতিমধ্যে বলেছেন, তাঁরা ফেসবুক ও গুগলের কাছে অসহায়। অর্থাৎ, এসব মাধ্যমে আসা তথ্য তা যত অসত্যই হোক, বন্ধ করতে পারছেন না) এসে হাজির হয় মানুষের কাছে। ফলে, একতরফা প্রচার কিংবা ঢোল পেটানোর যুগ সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা যদি মনে করে থাকেন তাঁরা যা বলেছেন, সেটাই মানুষ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তা হলে ভুল করবেন।
১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার দায় নিয়ে বিতর্ক আগেও হয়েছে এবং সেসব বিতর্কে আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। বিশেষ করে ১৫ আগস্ট বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার ঘটা করে কেক কেটে জন্মদিন উদ্যাপন ছিল তাদের সমালোচনার মুখ্য বিষয়। ১৫ আগস্টে কারও জন্মদিন হতে পারবে না, তা আমরা বলছি না। কিন্তু সেদিন একজন রাজনৈতিক নেতা, যিনি দেশের তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, মহাসমারোহে কেক কেটে জন্মদিন উদ্যাপন করবেন, এটা শোভন নয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য প্রয়াত মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে সে কথা লিখেছেনও। খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে মহাসমারোহে কেক কাটা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সর্বমহলেই প্রশংসিত হয়েছে। এটি করা হয়েছিল করোনা সংক্রমণের অনেক আগেই।
বিতর্কে স্বাভাবিকভাবেই ১৫ আগস্টের খুনিদের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের যোগাযোগের বিষয়টি এসেছে। ১৫ আগস্টের খুনিদের তিনি বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়েছেন, ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার বন্ধে খন্দকার মোশতাকের জারি করা অধ্যাদেশ সংসদে আইন হিসেবে পাস করেছেন, তা নিয়েও সমালোচনা হতে পারে। উল্লেখ্য, জিয়ার পর এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার খুনিদের বিদেশে চাকরি বহাল রেখেছিল (আওয়ামী লীগ নেতারা এ নিয়ে খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করলেও এরশাদের নাম কদাচিৎ উচ্চারণ করেন)।
১৫ আগস্টের ঘটনায় জিয়ার ভূমিকার নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কিংবা রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে জিয়ার লাশ আছে কি না, ৪১ বছর পর সেই বিতর্ক তোলার পেছনে ইতিহাসচর্চার চেয়ে রাজনৈতিক বিদ্বেষই বেশি ক্রিয়াশীল। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। তিনি ২৭ মার্চ রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছেন। জিয়া নিজ হাতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি গুলি ছুড়েছেন কি না, সেসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে যে মুক্তিযুদ্ধকেই বিতর্কিত করা হয়, আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতারা তা-ও বুঝতে অপারগ।
একইভাবে বিএনপির ‘দেশত্যাগী নেতা’ যখন স্বাধীনতাসংগ্রামে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকেই অস্বীকার করেন, তাতে ইতিহাস সম্পর্কে অর্বাচীনতাই প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা না চাইলে জিয়া কার নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন? একাত্তরের ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন, তখনই কার্যত বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। বাংলাদেশের অফিস-আদালত সবকিছু চলেছে বঙ্গবন্ধুর হুকুমে। এ ধরনের অর্বাচীন কথাবার্তা বিএনপিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
আবার আওয়ামী লীগ নেতাদেরও বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধে যদি জিয়া কোনো ভূমিকা না রেখে থাকেন, বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিল কেন? সেনাবাহিনীর উপপ্রধান পদেই বা কেন বসিয়েছিল?
১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির সব দায় জিয়াউর রহমানের ওপর চাপিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা গেলেও আত্মগ্লানি ঢাকার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা ছিল, তা বিচার করতে হবে একাত্তরের প্রেক্ষাপটে। পঁচাত্তরের ভূমিকা দিয়ে একাত্তরকে বিচার করা ভুল হবে
এবারের ১৫ আগস্টের বিতর্ক আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক ঝগড়ায় সীমিত থাকেনি। এমন কিছু বিষয় এসেছে, যা সেই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভিরুতা ও কাপুরুষতাই প্রকাশ পেয়েছে। সেই সময়ে বিরোধী দলের যে নেতারা বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিলেন (তঁাদের দাবি আন্দোলনের গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ হয়েছিল বলে তাঁরা এটি করতে বাধ্য হন), তাঁদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদ অলংকৃত করেছেন, কেউ কেউ জোটসঙ্গী হয়ে আছেন। আবার ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যে নেতা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, যিনি ভারতে ১৫ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন, তিনি এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নেই। তাই পঁচাত্তরের রাজনীতির হিসাব-নিকাশে এখনকার পরিস্থিতি মেলানো যাবে না।
পঁচাত্তরে কোনো কোনো বিরোধী দল বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি, এ সবই সত্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ সেদিন কী করেছিল, সেই প্রশ্নও উঠেছে এবং যৌক্তিকভাবেই। সেই সময়ে জাতীয় রক্ষী বাহিনীর উপপরিচালক আনোয়ার উল আলম লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কেউ এগিয়ে আসেননি। আনোয়ার উল আলমের ভাষ্য, ‘রাষ্ট্রের যাঁরা কর্ণধার অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল, তাঁরা কি তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন? তাঁরা তো দেশের উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের ক্ষমতার আসনে বসে ছিলেন। জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ে তাঁদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার দায়ভার কি তাঁরা এড়াতে পারেন?’ (রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা, আনোয়ার উল আলম শহীদ। প্রথমা প্রকাশন)। তিনি আরও লিখেছেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদ তখন কোনো পদে ছিলেন না। তিনি পদে থাকলে হয়তো কিছু একটা করতেন। সেই সময়ের ডাকসাইটে আমলা নাজমুদ্দীন হাশিম লিখেছেন, ফণীভূষণ মজুমদার ছাড়া সবাই স্বেচ্ছায় মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন।’ মোশতাক আহূত জাতীয় সংসদের অধিবেশনেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংসদ সিরাজুল হক ছাড়া কেউ জোরালোভাবে তাঁর অবৈধ শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেননি।
বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের টক শোতে বর্তমান মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্যের উদ্দেশে গবেষক-লেখক মহিউদ্দিন আহমদ সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘১৫ আগস্ট সকালে তো সবাই (আওয়ামী লীগের) ইঁদুরের গর্তে লুকিয়েছিলেন। আপনি কোথায় ছিলেন?’ মন্ত্রী মহোদয় প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি।
তাই ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির সব দায় জিয়াউর রহমানের ওপর চাপিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা গেলেও আত্মগ্লানি ঢাকার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা ছিল, তা বিচার করতে হবে একাত্তরের প্রেক্ষাপটে। পঁচাত্তরের ভূমিকা দিয়ে একাত্তরকে বিচার করা ভুল হবে। পঁচাত্তরের আগে যাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের অনেকে যেমন পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নেই, তেমনি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা কেউ কেউ পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, সাংসদ হয়েছেন, মন্ত্রিত্ব করেছেন। দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।
কিছুদিন আগে সিরাজগঞ্জ-৭–এর সাংসদ হাসিবুর রহমান মারা গেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু ছাত্রদলের হাত ধরে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জয় লাভও করেন। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে উপমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেওয়ায় তিনি সদস্য পদ হারিয়েছিলেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাসিবুর রহমান আওয়ামী লীগেই ছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিবের রাজনীতি শুরু ছাত্রলীগের হাত ধরে। তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। পরবর্তীকালে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কও হয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় ১৯৯৬ সালে বিএনপিতে যোগ দেন এবং এখনো বিএনপিতে আছেন।
এই দুই রাজনীতিকের ‘দেশপ্রেম’ ও ‘দেশদ্রোহ’ কীভাবে বিচার করবেন আওয়ামী লীগের নেতারা? যাঁরা ‘আমার সঙ্গে নেই, তাঁরা দেশ ও জাতির শত্রু’—এই তত্ত্ব কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না।
এই রাজনৈতিক বিতর্কে কে লাভবান আর কে ক্ষতিগ্রস্ত হলো? দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপি ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। তাদের হারানোর কিছু নেই। তাই তাদের ক্ষতির পরিমাণটা কম। কিন্তু আওয়ামী লীগ টানা এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। তাই ক্ষতির পরিমাণও তাদের বেশি বলে ধারণা করি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ বরাবর জবরদস্তির শাসন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব ও মানুষের ভোটাধিকার হরণের যেসব অভিযোগ করে আসছে, তারা নিজেরা কি সেসব অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি