গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালের জঙ্গি হামলার ঘটনা নিয়ে নির্মিত ভারতীয় ছবি ‘ফারাজ’ মুক্তি পেয়েছে ২০২৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। অথচ হোলি আর্টিজানের ঘটনার অনুপ্রেরণা নিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্র ‘শনিবার বিকেল’ চার বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে! ২০১৯ সালে সেন্সর বোর্ডে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির আপত্তিতে চলচ্চিত্রটির মুক্তি আটকে যায়। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফায় সেন্সর বোর্ডের সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ ছবিটি দেখার পর তাঁদের আপত্তিতে চলচ্চিত্রটির সেন্সর ছাড়পত্র প্রদান থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কারণ হিসেবে জানানো হয়, হোলি আর্টিজান হামলার মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে—এমন ভাবনা থেকেই চলচ্চিত্রটি মুক্তি দিতে দেওয়া হচ্ছে না। (আটকে গেল ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯) এ ছাড়া সেন্সর বোর্ডের বরাতে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ চলচ্চিত্রটি আটকে যাওয়ার যেসব কারণের কথা জানিয়েছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় মানুষের প্রাণ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জীবনদানের বিষয়টির অনুপস্থিতি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি, অপরাধ ও আইনহীনতা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও অশ্লীল সংলাপ ইত্যাদি। (‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি, আবার দেখবে আপিল কমিটি, প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
অনেক সমালোচনার মুখে গত ২১ জানুয়ারি সেন্সর বোর্ডের আপিল কমিটি চলচ্চিত্রটি মুক্তি দিতে আর কোনো বাধা নেই বলে জানালেও তার দুই সপ্তাহের মাথায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় সিনেমাটি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, সিনেমাটি আবার দেখবে আপিল কমিটি। এর ফলে আবারও আটকে যায় সিনেমাটির মুক্তি। (‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি, আবার দেখবে আপিল কমিটি, প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) অথচ চলচ্চিত্রটির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বরাবরই বলে আসছেন, ছবিটিতে তিনি সরাসরি হোলি আর্টিজানের ঘটনা পুনর্নির্মাণ করেনি, এমনকি ওই ক্যাফের ভেতরের কোনো চরিত্রেরও পুনর্নির্মাণ করেননি, তারপরও তার এই ছবি সেন্সরে আটকে রাখা হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি যা দাঁড়াল তা হলো, বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে বানানো ভারতীয় ছবি মুক্তি পেয়ে গেছে কিন্তু ওই ঘটনার স্রেফ অনুপ্রেরণা নিয়ে বাংলাদেশে বানানো চলচ্চিত্র ৪ বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে! অবশ্য বাংলাদেশে মুক্তি না পেলেও ১০ মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে ‘শনিবার বিকেল’। ভাবমূর্তির দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সেন্সর করা হলেও দেশের বাইরে ‘শনিবার বিকেল’ কিংবা ‘ফারজ’–এর প্রদর্শিত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে সেন্সর করার অর্থহীনতাই প্রতিষ্ঠিত হলো।
এ জন্য চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ডের বদলে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করা যেতে পারে, যার কাজ হবে চলচ্চিত্রকে বিভিন্ন বয়সী মানুষের জন্য রেটিং করে দেওয়া। পৃথিবীর বহু ভদ্র, সভ্য দেশে সেন্সরশিপের বদলে এভাবে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন প্রথা আছে, যার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তি ও তার পরিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোন চলচ্চিত্রটি পরিবারের সব সদস্য মিলে দেখা যাবে আর কোন চলচ্চিত্র শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের দেখার উপযুক্ত। এর ফলে এসব দেশের নাগরিকেরা সব উচ্ছন্নে গেছে বা দেশে হিংসা–হানাহানি–বিদ্বেষে ভরে গেছে, সে রকমটি মনে করার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ঔপনিবেশিক আমলের সেন্সরশিপ ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই ব্যবস্থায় কতিপয় আমলা ও সংস্কৃতিকর্মীর সমন্বয়ে গঠিত একটি সেন্সর বোর্ড ঠিক করে দেয় বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ কোন চলচ্চিত্র দেখতে পারবে, আর কোন চলচ্চিত্র তাদের জন্য উপযুক্ত নয়।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের অনুমোদন দেওয়া হয় দ্য বাংলাদেশ সেন্সরশিপ অব ফিল্ম রুলস-১৯৭৭–এর ধারা ১৩ এবং দ্য কোড ফর সেন্সরশিপ অব ফিল্মস ইন বাংলাদেশ, ১৯৮৫–এর ৮ দফা নির্দেশনার আলোকে। এসব বিধির ভিত্তি হলো ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত দ্য সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট-১৯১৮ এবং পাকিস্তান আমলে প্রণীত দ্য সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩ যেগুলো পাকিস্তান রাষ্ট্রে এবং বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে আরও সংশোধিত ও সংযোজিত হয়েছে। এই সব আইন ও বিধি অনুযায়ী যেসব কারণ দেখিয়ে সেন্সর বোর্ড কোনো চলচ্চিত্রের অনুমোদন আটকে দিতে পারে সেগুলো হলো দেশের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, অনৈতিকতা-নগ্নতা-অশ্লীলতা, পাশবিকতা ও বীভৎসতা, অপরাধ কর্মে উৎসাহ প্রদান, চলচ্চিত্র নকল করা, যৌতুক গ্রহণে উৎসাহিত করা ইত্যাদি। (চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ, অনুপম হায়াৎ, বাংলা পিডিয়া)
এই সব বিধি অনুসারে চলচ্চিত্র সেন্সর করার জন্য গঠিত সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে থাকেন তথ্য মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধি, এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাংবাদিক, নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, পরিচালক, চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রমুখ। প্রশ্ন হলো, এভাবে সরকার নিয়োজিত কতিপয় আমলা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত একটি সেন্সর বোর্ডের মাধ্যমে দেশের মানুষের চলচ্চিত্র দেখার অধিকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা কতটা যৌক্তিক?
প্রথমত, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন আর অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের যুগে শতবর্ষ আগের ঔপনিবেশিক যুগের সেন্সরশিপের ধারণা অচল। যে ধরনের বিষয়বস্তু থেকে দর্শককে রক্ষা করার যুক্তি দিয়ে একসময় সেন্সরশিপের জন্ম হয়েছিল, সেই সব বিষয়বস্তু এখন এমন সহজলভ্য, সেসবের এত বিচিত্র রকম বিকল্প উৎস রয়েছে যে শুধু কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে থাকা প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রকে সেন্সর করে তা থেকে মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মানুষ কোন চলচ্চিত্র দেখছে, সেটা যেমন ব্যক্তির বিবেচনার ওপর নির্ভর করে, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখার বিষয়টিও ব্যক্তির বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ব্যক্তিকে তার নিজের, পরিবারের এবং সমাজের বিচার-বিবেচনার ওপর নির্ভর করতে হয়। ব্যক্তি কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবে, কোন পেশা বেছে নেবে, কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ও কর্তৃত্ব যেখানে ব্যক্তি, তার পরিবার, স্বজন কিংবা তার সামাজিক পরিমণ্ডলের ওপর ন্যস্ত থাকে, সেখানে ব্যক্তি কোন চলচ্চিত্র দেখবে আর কোন চলচ্চিত্র দেখতে পারবে না, এ রকম বিষয়ের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র নিয়োজিত কতিপয় ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত রাখা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকারের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তৃতীয়ত, চলচ্চিত্রের সেন্সরশিপ বিষয়টিকে খাদ্য কিংবা ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের মতো সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড নির্ভর বিষয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। খাদ্য বা ওষুধে কোন উপাদান কী মাত্রায় থাকলে তা শরীরের জন্য ভালো বা মন্দ, তার যেমন সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড রয়েছে, চলচ্চিত্রের ভালো–মন্দ, শ্লীল-অশ্লীল, রুচি-অরুচি ইত্যাদির এমন কোনো সর্বজনগ্রাহ্য মানদণ্ড নেই। এগুলো একেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে একেক সময় একেক রকম হতে পারে। কাজেই এই সব অনির্দিষ্ট মানদণ্ডকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র সেন্সর করার আইন থাকলে তা ক্ষমতাবানদের স্বার্থরক্ষার কাজেই ব্যবহৃত হয়।
শুধু ‘শনিবার বিকেল’ই নয়, সেন্সর বিধির আওতায় বিভিন্ন অভিযোগে বাংলাদেশে আরও অনেক চলচ্চিত্রই প্রদর্শিত হতে পারছে না। এই সেন্সরব্যবস্থা যে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকার ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা সাম্প্রতিককালে সেন্সরে থাকা আরও কিছু চলচ্চিত্রর দৃষ্টান্ত থেকে সহজেই বোঝা যায়।
চাকমা ভাষায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘মর থেঙ্গারি’ বা ‘আমার বাইসাইকেল’ সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়া হয় ২০১৫ সালের মে মাসে। এরপর প্রায় আট বছর পেরোলেও সেন্সর ছাড়পত্র মেলেনি। চলচ্চিত্রটির পরিচালক অং রাখাইন জানিয়েছেন, সেন্সর বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রথমে ২০ সেকেন্ড এবং পরে আরও প্রায় ২৫ মিনিটের দৃশ্য কর্তন করতে বলা হয়। (আট বছর সেন্সরে আটকে আছে ‘মর থেঙ্গারি’, প্রথম আলো, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, চলচ্চিত্রটিতে ‘বাংলাদেশ সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্নকারী দৃশ্য ও সংলাপ উপস্থাপন’ করার অভিযোগে সিনেমাটিকে সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। (সরকারি বাধার মুখে চাকমা চলচ্চিত্র ‘মর থেঙ্গারি’?, বিবিসি বাংলা, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫)
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের রানা প্লাজা ধস এবং তার ১৭ দিনের মাথায় ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে রেশমা আক্তার নামের এক পোশাকশ্রমিকের জীবিত উদ্ধার হওয়ার ঘটনাকে উপজীব্য করে তৈরি ‘রানা প্লাজা’ নামের চলচ্চিত্রটি সেন্সর বোর্ডে জমা পড়ে ২০১৪ সালে। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে ছাড়পত্র দিচ্ছিল না। এরপর আদালতের নির্দেশে বেশ কিছু ‘ভয়ংকর ও হিংসাত্মক’ দৃশ্য বাদ দেওয়া সাপেক্ষে ২০১৫ সালে সেন্সর প্রদান করা হয়। আদালতের নির্দেশে সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়ার পরও ছবিটি মুক্তি পায়নি। কারণ সেন্সর বোর্ডের আপিল কমিটিতে আবেদন হওয়ার কথা বলে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনে স্থগিতাদেশ দেয়, এরপর আপিল কমিটি জনসম্মুখে প্রদর্শনের উপযোগী নয় বলে ‘রানা প্লাজা’ চলচ্চিত্রটিকে সেন্সর সনদবিহীন ঘোষণা করে। (আপিলেও ব্যর্থ চলচ্চিত্র ‘রানা প্লাজা’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৫ জানুয়ারি ২০১৬)
যে সব ‘ভয়ংকর ও হিংসাত্মক’ দৃশ্য কর্তন করেও এফডিসির চলচ্চিত্র ‘রানা প্লাজা’ শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেল না, সেই দৃশ্যগুলোর তালিকা দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় গার্মেন্টস শিল্পের অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে কী তীব্র আতঙ্ক এ দেশের মালিক গোষ্ঠী মধ্যে বিদ্যমান, যে আতঙ্ক থেকে তাদের মুক্তি দিতে আটকে দেওয়া হলো একটি এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রকে। সেন্সর বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া এই দৃশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টস কর্মীর উক্তি, ‘আমার হাতটা কাইটা বাইর করেন, ও ভাই, আমাকে বাঁচান’ (১৮ সেকেন্ড), গার্মেন্টস কর্মীর উক্তি, ‘ও ভাই আমাকে বাঁচান, কে আছেন আমাকে বাঁচান’ (৬ সেকেন্ড), টিটুর মা টিটুর বাবাকে ‘বদমাইশ’ বলে গালি দেওয়ার সংলাপ (৫ সেকেন্ড),‘তোরা খা, আমিও খাই’ শীর্ষক সংলাপ (৫ সেকেন্ড), ‘ঐটা দেখাইয়া আমরা রেশমার সঙ্গে মেলামেশা করব, ছবিও তুলব’- শীর্ষক সংলাপ (৬ সেকেন্ড), টিটুর মায়ের চিৎকারসংক্রান্ত সংলাপ (৪ সেকেন্ড), ম্যানেজার এক নারী শ্রমিককে ‘মালটা’ বলে উক্তি করার সংলাপ (৩ সেকেন্ড), রানার নাম উচ্চারণসংক্রান্ত সংলাপ (২ সেকেন্ড), এক গার্মেন্টস কর্মীর পা কাটার দৃশ্য ও তাঁর আর্তচিৎকারের দৃশ্য (২ সেকেন্ড), পোশাকশ্রমিক শাহিনাকে উদ্ধারকালে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কথোপকথনের দৃশ্য (১০ সেকেন্ড), মিডিয়াকর্মীদের সামনে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কথোপকথনের দৃশ্য (৯ সেকেন্ড), সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, সাভারের সাইন বোর্ড দেখানোর দৃশ্য (৩ সেকেন্ড), মোবাইলে ভিডিও দেখানোর দৃশ্য (৩ সেকেন্ড) ইত্যাদি। (‘রানা প্লাজা’ চলচ্চিত্রের সেন্সর কাহিনি, সর্বজনকথা, নভেম্বর ২০১৫) গার্মেন্টস মালিক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই যে ‘রানা প্লাজা’ চলচ্চিত্রকে আটকে দেওয়া হয়, সে বিষয়ে কোনো রাখঢাক ছিল না।
এই সব দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, নাগরিকের রুচি, অনুভূতি আর দেশের স্বার্থের পাহারা দেওয়ার নামে অনেক ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্র সেন্সর ব্যবস্থা কার্যত বিভিন্ন ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর স্বার্থের পাহারাদার হিসেবে কাজ করে। প্রচলিত সেন্সরব্যবস্থার আমূল সংস্কার না করলে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে এর ব্যবহার বন্ধ হবে না, শিল্পের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা যাবে না। এ জন্য চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ডের বদলে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন করা যেতে পারে, যার কাজ হবে চলচ্চিত্রকে বিভিন্ন বয়সী মানুষের জন্য রেটিং করে দেওয়া। পৃথিবীর বহু ভদ্র, সভ্য দেশে সেন্সরশিপের বদলে এভাবে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন প্রথা আছে, যার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তি ও তার পরিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোন চলচ্চিত্রটি পরিবারের সব সদস্য মিলে দেখা যাবে আর কোন চলচ্চিত্র শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের দেখার উপযুক্ত। এর ফলে এসব দেশের নাগরিকেরা সব উচ্ছন্নে গেছে বা দেশে হিংসা–হানাহানি–বিদ্বেষে ভরে গেছে, সে রকমটি মনে করার কোনো কারণ নেই।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক, প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: [email protected]