যে কারণে ইন্টারনেট বন্ধ করা থেকে সরে আসতে হবে

শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা সময়ে আন্দোলন–বিক্ষোভ দমনে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার বড় অভিযোগ ছিল সরকারের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময়ে সেটির ভয়াবহ রূপ আমরা দেখি। এর নানা প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণমূলক এ লেখা লিখেছেন কল্লোল মোস্তফা

তথ্য জানা, মতপ্রকাশ এবং বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য ইন্টারনেট এখন অপরিহার্য। ২০১২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচআরসির এক রেজল্যুশনে বলা হয়, ‘অফলাইনে মানুষের যেসব অধিকার রয়েছে, অনলাইনেও সেগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে।’ পরে ২০১৬ সালে ইউএনএইচআরসি ইন্টারনেট ব্যবহারের বাধা দানকারী সব ধরনের পদক্ষেপকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানায়।

২০২০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অনুরাধা ভাসিন বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলার রায়ে ইন্টারনেট বন্ধে সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত করে দেন। রায়ে বলা হয়, মতপ্রকাশ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার সাংবিধানিক সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য। মতপ্রকাশের অধিকার হরণের উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবে না। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ইন্টারনেট বন্ধ করতে হলেও আনুপাতিকতা ও প্রয়োজনীয়তার শর্ত পূরণ করতে হবে। ইন্টারনেট বন্ধের প্রতিটি আদেশ প্রকাশ করতে হবে এবং সাত দিনের মধ্যে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটির মাধ্যমে যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করতে হবে। সেই সঙ্গে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার সুযোগ থাকবে, ভুক্তভোগীরাও ইন্টারনেট বন্ধের যৌক্তিকতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে সরকার যেভাবে বিভিন্ন সময় ইন্টারনেট বন্ধ করেছে, তা মানবাধিকার হিসেবে ইন্টারনেটের অপরিহার্যতার ধারণার সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ ছিল না। জনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে সরকারি দুই সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) যখন-তখন আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দিত। এসব সংস্থা থেকে টেলিকম অপারেটরদের কখনো নির্দিষ্ট এলাকার বা সারা দেশের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করার, কখনো নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে প্রবেশাধিকার বন্ধের আদেশ দেওয়া হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) ও সাবমেরিন কেব্‌ল কোম্পানি ও ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেব্‌ল (আইটিসি) কোম্পানিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

■ যখন-তখন ইন্টারনেট বন্ধ বা ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা তৈরির পদক্ষেপগুলো কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছিল না। 

■ বিগত সরকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার কথা স্বীকারও করত না।

■ ইন্টারনেট বন্ধ করায় অর্থনৈতিকভাবে যে বিশাল ধাক্কা তৈরি হয়, তা আমলে নেওয়া হয় না। 

এভাবে নির্বাহী আদেশে যখন-তখন ইন্টারনেট বন্ধ বা ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা তৈরির পদক্ষেপগুলো কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থার ছিল না। বিগত সরকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার কথা স্বীকারও করত না। এই কাজে ব্যবহার করা হতো বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর ৯৭ ধারা অনুসারে, রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলে অথবা ‘সরকারের বিবেচনায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে’ সরকার মোবাইল অপারেটর ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করার আদেশ দিতে পারে। 

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের অবসান ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে সুযোগ এসেছে নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক স্বার্থে জনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে ইন্টারনেট বন্ধের সংস্কৃতি থেকে সরে আসার। এ জন্য টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ এবং বিভিন্ন লাইসেন্সিং নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।

মোবাইল অপারেটর ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডের লাইসেন্সের শর্তেও সরকারের নির্বাহী আদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধের শর্ত থাকে, যা তারা পালন করতে আইনগতভাবেই বাধ্য থাকে। ২০০১ সালের মূল আইনে শুধু জরুরি অবস্থার সময় ইন্টারনেট বন্ধের ক্ষমতা থাকলেও ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৭ ধারায় ‘সরকারের বিবেচনায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে’ কথাগুলো যুক্ত করা হয়, যা ব্যবহার করে বিগত সরকার বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক স্বার্থে ইন্টারনেট আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করেছে। বিগত সরকার ২০২৩ সালে তিনবার এবং ২০২২ সালে ছয়বার মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করেছিল। (গণতন্ত্র সুসংহত নয়, এমন দেশ ইন্টারনেট বন্ধ রাখে, প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২৪)

সম্প্রতি ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টি আলোচনায় আসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা থেকে। বিগত সরকার ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাত থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং ১০ দিন পর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু করা হয়। অবশ্য তারপরও আরও তিন দিন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবসহ অনেক জনপ্রিয় অ্যাপ বন্ধ রাখা হয়। সরকারি সংস্থাগুলো ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেনি; বরং তার বদলে ইন্টারনেট অবকাঠামোয় অগ্নিসংযোগের কল্পিত অজুহাত দেওয়া হয়েছিল।

ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এ সময় বহু ধরনের জরুরি সেবা নিতে পারেনি মানুষ। বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করতে না পেরে বিদ্যুৎ অফিসের সামনে মানুষকে দীর্ঘ লাইন ধরে দাঁড়াতে হয়। এ সময় মানুষ অনলাইনে কোনো ধরনের টাকা লেনদেন, মোবাইল রিচার্জ, ই-কমার্স, এফ-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, বিমানের টিকিট কেনা, অনলাইনভিত্তিক বিনোদনের মাধ্যম (ওটিটি, ইউটিউব) ব্যবহার, পড়াশোনা—কোনো কিছুই করতে পারেনি। এরপর ইন্টারনেট চালু করা হলেও জনপ্রিয় অ্যাপগুলো বন্ধ রাখার কারণে এবং ধীরগতির কারণে আরও বেশ কিছুদিন ইন্টারনেট ব্যবহারে মানুষকে ভোগান্তি পেতে হয়।

ইন্টারনেট না থাকায় বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সাররা। তাঁরা সফটওয়্যার, গ্রাফিকস, ওয়েব ডেভেলপমেন্টসহ তথ্যপ্রযুক্তির যেসব কাজ করেন, তার জন্য যেমন ইন্টারনেট প্রয়োজন, তেমনি ইন্টারনেট প্রয়োজন আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া-নেওয়ার ওয়েবসাইট বা মার্কেটপ্লেস থেকে কাজ জোগাড় করা বা গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। দেশের ৬ থেকে ১০ লাখ তরুণ ফ্রিল্যান্সার প্রায় দেড় শটি মার্কেট প্লেসে সক্রিয় থাকেন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এই ফ্রিল্যান্সাররা অনেক কাজ করতে পারেননি, শুরু করা কাজ শেষ করতে পারেননি, শেষ হওয়া কাজ গ্রাহকদের সময়মতো বুঝিয়ে দিতে পারেননি, গ্রাহকদের পাঠানো বার্তার উত্তর দিতে পারেননি। 

বিদেশের গ্রাহক ও কাজ টিকিয়ে রাখতে ইন্টারনেট পাওয়ার জন্য অনেক ফ্রিল্যান্সার দেশের বাইরে ব্যাংক, নেপাল, দুবাই ইত্যাদি দেশে নিজে গিয়ে বা দল পাঠিয়ে এই বিপর্যয় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বন্ধ করার পাঁচ দিন পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হলেও বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও ধীরগতির কারণে বেশ অনেক দিন ফ্রিল্যান্সাররা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেননি। ফাইল নামানো (ডাউনলোড), ফাইল আদান-প্রদান, গ্রাহক বা বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও অনলাইন সভা করতে নানা সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। (এত ধীরগতির ইন্টারনেট দিয়ে আমরা কী করব, প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২৪)।

এর ফলে ফ্রিল্যান্সাররা যে শুধু ব্যক্তিগতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নয়, তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কাজ ও বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ সম্পর্কে আস্থাও নষ্ট হয়েছে, যার ফলাফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশের ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে সময়মতো কাজ বুঝে না পাওয়ার কারণে ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পরিবর্তে তুলনামূলক সুবিধাজনক অন্য কোনো বিকল্প দেশ খুঁজবেন।

একইভাবে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময় আর্থিক ক্ষতির শিকার হন অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্স ও ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স উদ্যোক্তারা। নিজস্ব ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তাঁরা পণ্যের প্রচারণা ও বিক্রির ফরমাশ নিয়ে থাকেন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময় তাঁদের পণ্যের প্রচারণা ও বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ফলে তাঁরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনলাইন পণ্য ডেলিভারির সঙ্গে যুক্ত কর্মীরাও এ সময় কোনো আয় করতে পারেননি। ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ খুলে ব্যবসা করেন সেসব খুদে উদ্যোক্তা, যাঁদের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ব্যবসা করার মতো মূলধন থাকে না। এই উদ্যোক্তাদের অনেকেরই আয়ের একমাত্র উৎস ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স। 

যেমন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণা অনুসারে নারী এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের ৫৭ শতাংশের একক পেশা ফেসবুকে পণ্য বিক্রি এবং উদ্যোক্তাদের প্রায় ৩৯ শতাংশ এই ব্যবসার মাধ্যমে সংসার চালান। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দেশের ভেতর থেকে ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ থাকায় এই খুদে উদ্যোক্তারা ব্যাপক আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েন। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) হিসাব অনুসারে, ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ থাকায় দেশের অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা খাতে ১৩ দিনে প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ১০ দিনে এফ-কমার্স খাতে ক্ষতি ৬০০ কোটি টাকা, ই-কমার্স খাতে ৪০০ কোটি, অনলাইনভিত্তিক পর্যটন (ই-ট্যুরিজম) খাতে ৩০০ কোটি ও অনলাইনভিত্তিক সরবরাহ (ই-লজিস্টিক) খাতে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। (ইন্টারনেট বন্ধে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় ক্ষতি সাড়ে ১৭০০ কোটি টাকা, প্রথম আলো, ৩১ জুলাই ২০২৪)

ইন্টারনেট না থাকায় চট্টগ্রাম, মোংলা, বেনাপোলসহ অন্যান্য বন্দরে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শুল্কায়ন, বন্দরের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ডকুমেন্টেশন, পণ্যের ঘোষণা অনুযায়ী ইন্সপেকশন, কনটেইনার রাখার স্থান নির্ধারণ, ডিউটি আদায়সহ সব কার্যক্রম টানা পাঁচ দিন বন্ধ ছিল। নিজস্ব নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে বন্দরের কার্যক্রম সীমিতভাবে সচল রাখা হলেও শুল্কায়ন নথি না পৌঁছানোয় পণ্য ডেলিভারি ও জাহাজীকরণ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। (বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে আসছে, বাসস, ২৮ জুলাই ২০২৪)

ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময় অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত বার্তা আদান-প্রদানের বৈশ্বিক ব্যবস্থা সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এ সময়ে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সব ধরনের আর্থিক লেনদেন বন্ধ থাকে। এর ফলে অনেক ব্যাংক আমদানি বিল সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি, যে কারণে অনেক বিদেশি ব্যাংক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিলম্বে বিল পরিশোধের দায়ে বাড়তি অর্থ চায় ব্যাংকগুলোর কাছে। (ইন্টারনেট বন্ধের জের, আমদানি বিলে জরিমানার অর্থ গুনবে কে, প্রথম আলো, ২৯ জুলাই ২০২৪) এ ছাড়া প্রবাসীরা এ সময় বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সও পাঠাতে পারেননি, ফলে প্রবাসী আয়ও কমে যায়।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে দেশের আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, ব্যাংকিং, ই-কমার্স, এফ-কমার্সসহ গোটা দেশের অর্থনীতি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বিক্ষোভ বা আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হিসেবে ইন্টারনেট বন্ধ করা আত্মঘাতী কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিগত সরকার একদিকে নিজেদের স্মার্ট এবং ডিজিটাল প্রযুক্তিবান্ধব বলে দাবি করেছে, অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য পরিষেবা ইন্টারনেট খেয়াল খুশিমতো বন্ধ করেছে।

কিন্তু এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। জনগণের মতপ্রকাশ ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ইন্টারনেটের যে গুরুত্ব, তাতে একে মৌলিক অধিকারের মতো আবশ্যিক পরিষেবা হিসেবে দেখতে হবে। বিক্ষোভকারীরা ব্যবহার করবে বলে দেশের রেল ও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া কিংবা কোনো এলাকার গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সর্বরাহ বন্ধ করে দেওয়া যেমন যৌক্তিক নয়, তেমনি বিক্ষোভকারীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করবে বলে ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে ইন্টারনেটের ওপর দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, যোগাযোগ, শিক্ষা, গবেষণা—সবকিছুর নির্ভরশীলতা প্রতিনিয়তই আরও বাড়ছে। ইন্টারনেট বন্ধের ফলে এখনই যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়, সামনের দিনগুলোয় তা একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠবে। ফলে বিক্ষোভ দমনে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের মতো আদিম মধ্যযুগীয় পদ্ধতি অবলম্বন দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদেশি বিনিয়োগকারী কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়।

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের অবসান ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে সুযোগ এসেছে নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক স্বার্থে জনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে ইন্টারনেট বন্ধের সংস্কৃতি থেকে সরে আসার। এ জন্য টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ এবং বিভিন্ন লাইসেন্সিং নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।

কল্লোল মোস্তফা টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ও বিশ্লেষক