২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

‘জিনের আসর এবং মানসিক চিকিৎসা’

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব, পেশাদার কূটনীতিক জনাব মো. তৌহিদ হোসেন ১২ মে প্রথম আলোতে ‘জিনের আসর এবং মানসিক চিকিৎসা’ শিরোনামের একটি লেখায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে রয়েছে নানা কুসংস্কার আর ভ্রান্ত ধারণা। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এ বিষয়ে ৩৬টি গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী লোকজনের একটা বড় অংশের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য ও এর চিকিৎসা বিষয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাবনা ও আচরণ—দুইই পাওয়া গেছে। বাংলাদেশেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কুসংস্কার আর ভ্রান্ত বিশ্বাস রয়েছে। মানসিক রোগের লক্ষণকে জিনের আসর হিসেবে বিবেচিত করা, মানসিক রোগ নিরাময়ে ঝাড়ফুঁক আর পানিপড়ার ব্যবহার এমনকি শরীরে গরম ছ্যাঁকা দেওয়াসহ নির্যাতনের মাধ্যমে ‘চিকিৎসা’ করার পদ্ধতি এখনো বর্তমান।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অর্থায়নে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একটি জাতীয় জরিপ অনুষ্ঠিত হয়। সেটার ফলাফলে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক লোকজনের মধ্যে ১৮.৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। নারীদের মধ্যে এ হার ২১.৫ শতাংশ আর পুরুষদের মধ্যে ১৫.৭ শতাংশ। আর যাঁরা মানসিক রোগে ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে ৯১ শতাংশই কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা গ্রহণ করছেন না। গবেষণায় উঠে এসেছে, অংশগ্রহণকারী লোকজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ (৩৭-৯৮%) মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভ্রান্ত নেতিবাচক ধারণা (স্টিগমা) পোষণ করে!

এমতাবস্থায় জনাব মো. তৌহিদ হোসেনের লেখাটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও জরুরি। ‘ইতিহাসের এমএ’ হয়েও তিনি মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন, এ জন্য তাঁকে বিশেষ ধন্যবাদ। লেখক মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নিজের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন। ওনার বাসার গৃহকর্মীর ১১ বছরের সন্তান যে মানসিক রোগে ভুগছিল, তার চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ দিয়েছেন।

জনাব মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ওনার ভাবনাকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করে এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিনয়ের সঙ্গে দু-একটি কথা উল্লেখ করতে চাই।

তিনি কিশোরগঞ্জে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। ‘অবিশ্বাস্য তথ্য’ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘৩০ লাখ লোকের বাস যে জেলায় (যে জেলা থেকে বাংলাদেশ পরপর দুজন রাষ্ট্রপতি পেয়েছে বাংলাদেশ) সেখানে একজনও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই।’ ওনার তথ্য সংগ্রহপদ্ধতিতে নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোনো গলদ ছিল। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, কিশোরগঞ্জের একমাত্র সরকারি মেডিকেল কলেজ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কর্মরত এবং সেই সরকারি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ স্বপদে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া বাজিতপুরে জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে একজন অধ্যাপক পদমর্যাদার বেসরকারি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দীর্ঘদিন ধরে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন, তিনি সেই হাসপাতালের ক্যাম্পাসেই বসবাস করেন। আরেকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ—মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজে একজন বেসরকারি নারী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক পদে কাজ করে যাচ্ছেন। কেবল খাতায় নয়, বাস্তবেও এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। জনাব হোসেন নিশ্চয়ই বিষয়টি পুনরায় যাচাই করবেন। তিনি কেন তাঁদের খুঁজে পেলেন না, সেটি নিশ্চয়ই একটি ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ।

তিনি ২৬০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মধ্যে ৬০ জনকে জেলায় পদায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু উনি হয়তো জানেন না, এই ২৬০ জনের মধ্যে মাত্র ১২০ জনের মতো সরকারি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। এই ১২০ জনকে দেশের ৩১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতালে বিতরণ করতে গিয়েই চরম লোকবল সংকট দেখা দিয়েছে। দেশে বছরে ৫-১০ জন করে নতুন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছেন, যা নিতান্তই অপ্রতুল। ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ৮টি অধ্যাপক পদের মধ্যে ৭টিই শূন্য! দেশের মাত্র ৩টি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক পদায়িত আছেন। বাকি ২৮টিতে পদ থাকলেও নেই কোনো অধ্যাপক পদায়ন। এমতাবস্থায় সম হারে জেলায় জেলায় বিতরণ করা নিতান্তই অসম্ভব।
·

তিনি একটি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে চিকিৎসকদের তুলনা করেছেন। দেশের চিকিৎসকেরা হচ্ছেন সবচেয়ে নিগৃহীত পেশাজীবী। অনেকটা ‘গরিবের বউ’। তাই সব গালিগালাজ কেবল চিকিৎসকদের জন্য। ‘ডাক্তাররাই বা ব্যতিক্রম হবেন কেন’ বলে যে শ্লেষোক্তি করেছেন, তা চিকিৎসকের জন্য অবমাননাকর। ডাক্তাররা অবশ্যই ব্যতিক্রম। ডাক্তাররা অন্যতম পেশাজীবী, যাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে গ্রামে ৩ বছর কাটাতে হয়, নতুবা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা যায় না। প্রশাসন, পুলিশ প্রভৃতি ক্যাডারেও মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অনেক কুলীন ক্যাডার আছেন, যাঁদের কোনো দিন গ্রামে যেতে হয় না। কিশোরগঞ্জের অনেক হাওর এলাকা ‘হার্ড-টু-রিচ’ হিসেবে চিহ্নিত। কাকতালীয়ভাবে সেসব এলাকায় মানসিক স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগের চিকিৎসাসেবা কীভাবে আরও পোক্ত করা যায়, তা নিয়ে একটি গবেষণা চলমান। সেই গবেষণাকাজের অংশীদার হিসেবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অনেক প্রতিবেশী দেশের তুলনায় শক্তিশালী। ‘ক্ষমতাবানদের ধরাধরি করে’ চিকিৎসকেরা ঢাকায় থাকলে সে সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো না।

জনাব হোসেনের জানার জন্য যে বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই তা হচ্ছে, মেডিকেলের এমবিবিএস কারিকুলামে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি এত অবহেলিত যে মাঠপর্যায়ে একজন চিকিৎসক এমবিবিএস পাস করার পর মেডিসিন, সার্জারি বা গাইনিতে যতটা দক্ষ থাকেন, মানসিক চিকিৎসায় ততটা দক্ষতা দেখাতে পারেন না। এ জন্য একদিকে মেডিকেল কারিকুলাম আধুনিকায়ন করতে হবে, আরেক দিকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ইনসার্ভিস ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সিদ্ধান্তগুলো নিতে হলে স্বাস্থ্যসেবার নীতিনির্ধারণী সব পর্যায়ে চিকিৎসক—একমাত্র চিকিৎসকদের পদায়ন জরুরি।

বাংলাদেশে বর্তমান সরকার বিগত এক দশকে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যে পরিমাণ গুরুত্ব প্রদান করেছে আগের ৪০ বছরে তার ছিটেফোঁটাও দেওয়া হয়নি। ১০৯ বছরের পুরোনো ইন্ডিয়ান লুনাসি অ্যাক্ট বাতিল করে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য আইন পাস করা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যনীতি এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় কর্মকৌশল চূড়ান্ত করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের বিকল্প হিসেবে প্রতি জেলায় ২ জন করে চিকিৎসকের ৮৫ দিনের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। পালাক্রমে কিশোরগঞ্জ জেলাও এই প্রশিক্ষণের আওতায় আসবে।

চিকিৎসকদের পদোন্নতি কেন হয় না, কেন আন্তক্যাডার বৈষম্য স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দিন দিন বেড়ে চলেছে, বিগত ২১ মাস বিনা ছুটিতে বিনা প্রণোদনায় কাজ করতে করতে চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্য কোন অবস্থায় আছে, কেন অবসরের পরপরই কর্তাব্যক্তিরা সবাই সত্যকথনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন আর পদে থাকাকালীন সময়ে কেন চুপ থাকেন—এসব বিষয়ে ম তৌহিদ হোসেন কিছু লিখবেন সেই প্রত্যাশা করছি।

ডা. আহমেদ হেলাল মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক।