রানা দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার, সাচার কমিটির প্রতিবেদন ও একটি প্রতিক্রিয়া

২০ আগস্ট প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারে একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করেছেন। রানা দাশগুপ্তের চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে চাই।

রানা দাশগুপ্ত তাঁর সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান দীর্ঘ শাসনামলের পূর্বে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ‘কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি’। তাঁদের ‘সর্বক্ষেত্রে বঞ্চনা ও বৈষম্য ছিল’। ফলত বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের হিস্যা ছিল কম।

বিপরীতে ভারতীয় মুসলমানদের সরকারি চাকরিতে অংশীদারত্ব প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তাঁর যে বক্তব্য, তা প্রকারান্তরে ভারতীয় মুসলমানদের ওপর বৈষম্যকে অস্বীকার করার শামিল। সরকারি চাকরিতে অংশীদারত্বের প্রশ্নে তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চাকরিবাকরি কিন্তু হয় শিক্ষার ভিত্তিতে। সেখানকার মুসলমানদের প্রবণতা হলো মাদ্রাসায় সন্তানদের পাঠানো। মাদ্রাসায় যাঁরা পড়েন, তাঁরা মূলধারার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারেন না।’

কিন্তু রানা দাশগুপ্ত যা দাবি করেছেন, তা ভারতের সাচার কমিটির প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থা নিরূপণের জন্য কংগ্রেসের মনমোহন সিংয়ের শাসনামলে ২০০৫ সালে দিল্লি হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি রাজিন্দর সাচারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। যেটি সাচার কমিটি হিসেবেই সুপরিচিত।

সাচার কমিটি বলছে, সারা ভারতে স্কুলে যাওয়ার বয়সী মুসলিম শিশুদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় যায়। মুসলিম অধ্যুষিত এক–তৃতীয়াংশ গ্রামেই কোনো স্কুল নেই। মাইলের পর মাইল মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকে না। তুলনামূলকভাবে মুসলিম বসতি বেশি, এমন প্রায় ৪০ শতাংশ বড় গ্রামগুলোয়ও কোনো চিকিৎসাসুবিধা নেই। ফলে মাদ্রাসায় সন্তানদের পাঠানো সরকারি চাকরিতে ভারতীয় মুসলমানদের অংশগ্রহণের অন্তরায়, রানা দাশগুপ্তের এ দাবিটি অবান্তর।

সাচার কমিটির প্রায় সাড়ে চার শ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বঞ্চনা, উপেক্ষা, জাতিগত অবজ্ঞা ও জুলুমের এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে। প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, ভারতের সরকারি চাকরিতে ১৪ শতাংশের বেশি মুসলিম জনসংখ্যার বিপরীতে তাঁদের অংশগ্রহণ মাত্র ৪.৯ শতাংশ। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোয়, যেমন পুলিশে তফসিলি ও ওবিসি জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের হার যেখানে যথাক্রমে ১২ এবং ২৩ শতাংশ, সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ মাত্র ৪ শতাংশ। ব্যাংকঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও তাঁরা বৈষম্যের শিকার। কিছু ব্যাংক মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে ‘নেগেটিভ জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে।

আমাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে বর্তমানে প্রায় ২৭ শতাংশের বেশি মুসলমান। অথচ সাচার কমিটির প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সরকারি চাকরির উচ্চ ও নিম্ন ধাপ মিলিয়ে মুসলমানদের অংশগ্রহণ মাত্র ৩.৪ শতাংশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনামলে অবশ্য এ হার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ইনস্টিটিউট, অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ ও গাইডেন্স গিল্ড কর্তৃক সাচার কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার এক দশক পরে করা সমীক্ষায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, যেসব ব্লকে মুসলমান জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের কম, সেখানে আনুপাতিক হারে প্রতি লাখ মানুষের জন্য ২.৩টি করে হাসপাতাল রয়েছে। আর যে ব্লকগুলোয় বেশিসংখ্যক মুসলমান মানুষের বাস, সেখানে প্রতি লাখ মানুষের জন্য হাসপাতালের পরিমাণ ১.৪। মুসলিমপ্রধান ব্লকগুলোয় স্কুলের সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বহুলাংশে কম।

ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে আনুপাতিকভাবে মুসলিমরাই সবচেয়ে বেশি নিম্ন আয়ের। ফলে অভাবের তাড়নায় মুসলিম শিক্ষার্থীদের একটা অংশ স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। এই ঝড়ে পরা রোধে সরকারের পদক্ষেপের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাই শিক্ষার গড় হারেও মুসলিমরা পিছিয়ে রয়েছে। সাচার কমিটি ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থাকে দলিতদের চেয়েও খারাপ বলে মন্তব্য করেছিল। মুসলিম সমাজের দুরবস্থার উত্তরণ যে হয়নি, তা বলাই বাহুল্য।

সাচার কমিটি মুসলিম সমাজের অনগ্রসর অবস্থার সমাধানে যে সুপারিশ করেছিল তার অন্যতম ছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক কাঠামোয় আরও সম্পৃক্তকরণ। অথচ ক্রমেই হয়েছে তার উল্টো। বর্তমান ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের একজনও মুসলিম এমপি নেই। ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পূর্ণ কলেবরের এই মন্ত্রিপরিষদে একজনও মুসলিম মন্ত্রী নেই। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ব্যাপক বিকাশের মুখে ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা যে ক্রমান্বয়ে আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

রানা দাশগুপ্ত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন বড় নেতা। তিনি একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীও। তাঁর নিশ্চয়ই সাচার কমিটির ঐতিহাসিক এই দলিলের বিষয়টি না জানার কথা নয়। এর পরও কীভাবে তিনি ভারতের মুসলিমদের নিয়ে এমন মন্তব্য করলেন, তা আমার বোধগম্য নয়।

সূত্র:
1. https://www.minorityaffairs.gov.in/show_content.php?lang=1&level=0&ls_id=14&lid=14
2. https://www.thehindu.com/news/cities/kolkata/bengals-predominantly-muslim-blocks-have-fewer-hospitals-study/article8277636.ece/amp/
3. https://prsindia.org/files/policy/policy_committee_reports/1242304423--Summary of Sachar Committee Report.pdf

  • আরজু আহমাদ তরুণ লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট