নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর রায় ও সর্বজয়ার আজন্মলালিত স্বপ্ন কিশোর অপুর সমানে তাসের ঘরের মতো নুয়ে পড়ার গল্প কিংবা রাণাঘাটের রেলবাজারে রসুয়ে-বামুন হাজারি ঠাকুরের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ খোলার রূপকথাগুলোয় জমেছে ধুলাবালুর আস্তরণ। পথের পাঁচালী, পদ্মা নদীর মাঝি, সূর্য দীঘল বাড়ি, বরফ গলা নদী, সেই সময়, দেবদাস উপন্যাসগুলো নিচতলার বুক শেলফে থরে থরে সাজানো আছে। অন্য শেলফে শোভা পাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ, আল মাহমুদ, মধুসূদন সমগ্র ইত্যাদি। ওপর তলার সব শেলফ একাডেমিক বইপত্রে ঠাসা। অথচ, পড়ার টেবিলে দ্যুতি ছড়াচ্ছে জব সলিউশন, ইংলিশে জিরো টু হিরো, ছন্দে ছন্দে কবি-সাহিত্যিকদের রচনাবলি, মনে রাখার সহজ উপায়ের মতো চাকরির বাজারে দোর্দন্ডপ্রতাপশালী কেতাবগুলো। তোতা পাখির মতো রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের নাম মুখস্থ করার বিরতিহীন চেষ্টার ফাঁকে এক হাত দূরত্বের বুক শেলফ থেকে ‘সোনার তরী’ খুলে দুই লাইন পড়ে সময় নষ্ট করার ঝুঁকি নিতে নারাজ যে কেউই।
আপাতদৃষ্টিতে এটিকে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে ফেব্রুয়ারি লাইব্রেরির চিত্র ভেবে ভ্রু কুঁচকালেও দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে এর ব্যত্যয় ঘটে না। একাডেমিক বিষয়ে গভীর পড়াশোনা কিংবা শিল্প-সাহিত্যের জগতে বিমুখতার বীজ প্রোথিত হয়েছে বহু আগে। অঙ্কুরিত চারাগাছটি এখন কেবল ডালপালা ছড়িয়ে পরিণত হয়েছে বটবৃক্ষে, যার ছায়ায় ম্লান হচ্ছে গবেষণা কিংবা সাহিত্যের মতো মৌলকতার নিখাদ চর্চা।
তরুণেরা কেন নিজেদের উত্তাল ও একমুখী প্রবল স্রোতে ভাসিয়ে নিচ্ছে, তা বুঝতে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধের প্রয়োজন নেই। পরিসংখ্যানে বেকারত্বের পাহাড়সম উচ্চতা বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের বিশাল সংখ্যা তাদের মনে গভীর রেখাপাত করেছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। প্রমিত বাংলায়, প্রায় প্রতি দুজনের একজন বেকার।
দেশে সমর্থ বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ বলছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দৃশ্যমান অঙ্কে বাংলাদেশে বেকার সংখ্যা তিন কোটি। সংস্থাটির পূর্বাভাস মতে, এই সংখ্যা আগামী কয়েক বছরে দ্বিগুণ হলে, তা হবে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। সম্প্রতি এমন শঙ্কার কথাই ছেপেছে দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক, যা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে চলমান চাকরির প্রস্তুতির পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে।
২.
এখন কেন আর রবীন্দ্রনাথ জন্ম নেন না?
এমন প্রশ্নের জবাবে দেশের বাজারে বেশ চমকপ্রদ একটি প্রতিক্রিয়া চাউর আছে। পরিবার পরিকল্পনার যুগে কেউ চতুর্দশ সন্তান নেওয়ার মানসিকতা লালন করেন না বলে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব হয় না এই কালে।
হুমায়ূন আহমেদের ধারায় প্রমিত বাংলায় সরস প্রাণের জীবন্ত উপাখ্যান কেন রচিত হয় না? এই ভূখণ্ডের সব শ্রেণি-পেশার যাপিত জীবনের নিগূঢ় স্পন্দন বা মর্মব্যথার মিতালী আর কেউ কেন বাঁধতে পারেন না?
প্রশ্নগুলো বেশ ভারী। দায়িত্ব নিয়ে মূল খোঁজার চেয়ে দায়সারা উত্তরদাতার পাল্লায় ভারী হয় এসবে। আর তাই বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রীত হয় ‘ইংরেজি শিখুন ঘরে বসে’। তারই পাশে অনাদরে পড়ে থাকে জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি কিংবা মধুসূদনের কপোতাক্ষ নদের বন্দনা গাথা। গ্রামবাংলার নিভৃত পথে-প্রান্তরে ধুলোমাখা যে আয়োজন বিভূতিভূষণ পরম মমতায় সাজিয়েছেন, তাঁর সুলুক সন্ধান করার তাগিদ ক্রমেই উবে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের প্রাচীন সভ্যতা, লড়াকু সংগ্রামের ইতিবৃত্ত, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, মহাকাব্যগুলো পড়বে কারা?
৩.
শিক্ষার কোনো বয়স নেই, শেখাই শেষ বলে কিছু নেই। প্রবাদ প্রবচন কিংবা প্রচলিত আলাপে এমনটা বেশ শোনা যায়। ব্যক্তিভেদে হেরফের হলেও মোটাদাগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্বেই সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এবং জীবনঘনিষ্ঠ পাঠগুলো উৎসারিত হয়। জীবনের দর্শন ও সত্তার অনাবিষ্কৃত অবয়ব অভিনব ধাঁচে ধরা দেয়। পৃথিবীর বিপুল বিস্ময় অন্বেষণের যে অপার কৌতূহল মানসপটে খেলা করে, তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়ার মানসিক শক্তি ও মনোবল সঞ্চিত হয় উচ্চশিক্ষার মৌসুমে। ফলাফলের খাতায় দুই নম্বর বেশি পাওয়ার লোভে শৈশবে কত কঠিন বাক্য ঠোঁটের ডগায় রাখতে হতো তাঁর ইয়াত্তা নেই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ভোগে সুখ নেই, গতিই জীবন, অর্থই অনর্থের মূল-সাহিত্য জাতির দর্পণস্বরূপের মতো অন্তর্হিত ভাবকে সম্প্রসারিত করেছি অন্যের মস্তিষ্ক প্রসূত ভাবনায়। আর নিজের মতো করে এসবের গূঢ়ার্থ সন্ধান করার কালে আমাদের ব্যগ্রতা একেবারে নিরুত্তাপ। কোনো বিষয় ব্যবচ্ছেদের জন্য মানসিক পরিপক্বতা জরুরি। মাধ্যমিক শ্রেণির বাংলা সাহিত্যের বইয়ে ‘আমার পথ, বই পড়া’ প্রবন্ধগুলোর গভীরতা, লেখকের বার্তা ও নিবেদন কতজন শিক্ষার্থীকে ছুঁতে পেরেছে, সেটা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে।
এসব অপ্রাসঙ্গিক আলাপের প্রাসঙ্গিকতা চারিধারে বিরাজমান। প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষাগুলোতে বাংলা সাহিত্যের নানাবিধ শাখা থেকে প্রশ্ন হয়। তাঁর জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে চাকরিপ্রত্যাশীরা দু-চারখানা বই পড়ার যেটুকু প্রয়াস পান, তাতে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি ন্যূনতম দরদের লেশমাত্র থাকে না। মুখ্য চরিত্রকে ঘিরে আয়োজনের সারমর্ম ও বইয়ের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনাতে ঘুরপাক খায় আমাদের সাহিত্যচর্চা। চাকরি নামের সোনার হরিণের নেশায় অস্পর্শই থেকে যাচ্ছে সাহিত্যের বিপুল ভান্ডার। প্রজাতন্ত্র তাঁর কর্মচারী নিয়োগের আত্মঘাতী প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে বলেই পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীটি গবেষণা শিকেয় তুলে মুখস্থ করছে মঙ্গোলিয়ার রাজধানীর নাম। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীটি মহা ব্যস্ত ইংরেজি ব্যাকরণ গলাধঃকরণে।
প্রমথ চৌধুরীর মতে, ‘জাতি হিসেবে শৌখিন না বলে বই পড়া আমাদের জন্য বিলাসিতা। সংকীর্ণমনা জাতির জ্ঞান সীমাবদ্ধ। ধনের ভাঁড়েও ভবানী।’
মানুষের মনকে সচল, সরাগ ও সমৃদ্ধ করার জাদুমন্ত্র আচ্ছাদিত আছে সাহিত্যে। বিদ্যমান বাস্তবতায় সে ফুরসত আমদের মিলছে না। সাহিত্যাঙ্গন যাঁদের পদচারণে মুখর হওয়ার ঈপ্সিত ছিল, তাঁরা মুখ গুঁজে আছেন ভিনদেশি সংস্কৃতির চাকচিক্য কিংবা মসৃণ জীবনের সন্ধানে। চাকরির প্রস্তুতি সাহিত্যচর্চার একমাত্র অন্তরায় নয়, বরং এটির প্রবল প্রতাপ তরুণদের সাহিত্যের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন, একাগ্র নিবেদনকে ছিন্ন করেছে। সামাজিক মর্যাদার কাঠামোয় সাহিত্য বা সাহিত্যিকের বিশেষ কদর নেই বলে শখ কিংবা পেশা হিসেবে এটিকে লালন করা অলাভজনক। সাহিত্যের চর্চা চোখে বিঁধছে নিছক সময়ের অপচয় হিসেবে। এতে ত্বরিত উদরপূর্তির সংযোগ নেই বলে বইপড়ুয়া যে কাউকে নিমেষেই ভবঘুরে বলে ফেলা সহজ। উদরের দাবিতে মনের আহ্বান উপেক্ষা করে যে নিরানন্দ আত্মার লালন করেই চলেছি, তাতে জীবনীশক্তির পতন অবশ্যম্ভাবী।
জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বেঁচে থাকলে বলতেন, এ হেন তমসাচ্ছন্ন আত্মার শিক্ষিতে জাতির কী হইবে?
মাহমুদুল হাছান
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
[email protected]