২০২১ সালের একটা হিসাবে দেখানো হয়েছিল, বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এই মূল্য দিয়ে পণ্য আমদানি করার পরও দেশের অর্থনীতি অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য অবস্থায় থাকবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। অথচ সেই সময় করোনা মহামারি চলছিল। ফলে বিশ্বের অনেক দেশ দেউলিয়া হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছিল ওই সময়ে। অথচ আমরা অনেক ভালো অবস্থায় অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ ২০২২ সালের দিকে এসে অর্থনীতিতে টানাপোড়েন শুরু হলো। দেশের অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্বিগুণ বাড়ল। আচ্ছা, এই যে দাম বাড়া নিয়ে কথা বলছি, তার সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক কোথায়? আর ডলার কী এমন মূল্যবান মুদ্রা যে মুদ্রার মান ধরে রাখতে হবে।
সময় ১৯৮৩ সাল, ঠিক এই সময় থেকেই বাংলাদেশ ডলারকে রপ্তানি এবং আমদানি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করল। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্রিটিশ পাউন্ডকে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বাংলাদেশের বর্তমানে ৯০ শতাংশ লেনদেন হয় ডলারের মাধ্যমে। আর এই ডলারের মান নির্ধারণ করে দেয় আমেরিকার কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ফেড।
বাংলাদেশে ডলারের এমন অবস্থার জন্য করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনে করোনার পুনরায় আগমনকে দায়ী করা হয়। আরও বলা হয়, প্রবাসী আয়ের বড় একটা অংশ এখন আর বৈধ পন্থা অবলম্বন করে দেশে আসছে না। হুন্ডির মাধ্যমে এই প্রবাসী আয়ের বড় একটা অংশ দেশে আসছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, সেটাও এই সংকট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের রিজার্ভ মুদ্রা দেখানো হচ্ছে ৩২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্য আট বিলিয়ন ডলার ব্যবহারযোগ্য নয়।
এ-ই যদি হয় রিজার্ভের অবস্থা, তখন তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে শুরু করে দেশের বাজারব্যবস্থায়। দেশের যেসব পণ্যসামগ্রী আমদানি করতে হয়, সেসব পণ্যের দাম এখন বেড়েই চলছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বেড়ে চলেছে। অথচ তেল-গ্যাসের দাম বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী। সরকার বলছে, ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে নিয়ে আসার ফলে দাম বাড়ছে। এই দাম বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আবার ইউরিয়া সারের যে ভর্তুকি দেওয়া হতো, তারও পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে অতি প্রয়োজনীয় ইউরিয়া সার ক্রয় করতে কৃষককে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
দেশের সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে এমন নাজুক পরিস্থিতির কারণ হিসেবে ডলার-সংকটকে দায়ী করা যায়। এই ডলার-সংকটের কারণটা একটু বিশ্লেষণ করা যায়। বাংলাদেশের ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, সেখান থেকে বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বলা হয়ে থাকে, ডলারের বিপরীতে কোনো দেশের মুদ্রা ১০ শতাংশ দাম হারালে মূল্যস্ফীতি বাড়ে ১ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে তার টাকার মান হারিয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে গত ডিসেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক শূন্য ৫ থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ হয়েছে। ডলারের দামের পাশাপাশি আমদানি পণ্যের বাড়তি দাম মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পণ্যসামগ্রীর এই বাড়তি দামের চাপ পড়তে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের ওপর।
ডলারের এমন অবস্থায় আইএমএফ তার সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে মুদ্রার মান ধরে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ১৯০টি সদস্যভুক্ত দেশে যেন কোনো অস্থিরতা বিরাজ না করে, এ বিষয়ে সোচ্চার আইএমএফ। এ কারণে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে আইএমএফ, যাতে বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে ডলারের দাম বাড়ে এবং তার মান ঠিক করতে কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বিশ্ব সংস্থা?
এই প্রশ্নের উত্তর করোনাকালের সংকট মোকাবিলা করার জন্য ফেড একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আর সেটা হলো, ফেড ডলার সরবরাহ বৃদ্ধি করে। ফলে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেডের মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ শতাংশ, গত ডিসেম্বরে থেকে যা ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। সরবরাহ বাড়ার পাশাপাশি ফেড মূল্যস্ফীতি যেন না ঘটে, এ জন্য দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে ফেডে এখন ডলার রাখলে সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এতে সাধারণত ধনী দেশগুলো তাদের ডলারগুলো ফেডে রেখে মুনাফা নিয়ে নিচ্ছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতো বিনিয়োগপ্রত্যাশী দেশগুলোর ওপর। কারণ, এসব দেশ কাঙ্ক্ষিত ডলার সরবরাহ পাচ্ছে না।
বিদায়ী বছরের যুক্তরাষ্ট্রের ফেড ৭ দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে, যেমন ছয় মাস মেয়াদের সোফরের সুদহার এখন ৪ দশমিক ৮১ শতাংশের সঙ্গে রয়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ। ফলে বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলার আমদানি করতে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে। এদিকে মূল্য অবমূল্যায়ন বেড়েছে। যেখানে আগে ১ ডলারের বিপরীতে ৮৫ টাকা পাওয়া যেত, সেখানে ১০৭ টাকায় ডলার বিক্রির করায় ২২ টাকা অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। অন্যদিকে রপ্তানিকারকেরা প্রতি ডলার থেকে বাড়তি ২২ টাকা বেশি হাতে পাচ্ছে, এতে রপ্তানি ব্যয় বেড়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আরও খারাপের দিকে যেতে পারি আমরা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রবাসীদের বৈধ পথে অর্থ প্রেরণ নিশ্চিত করতে পারলে আর অর্থ পাচার বন্ধ করতে পারলে এই সংকট আর দীর্ঘায়িত হবে না। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার কতটা সফলভাবে এই সংকট মোকাবিলা করতে পারে। এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করি, যেন সফলভাবে সবকিছু সমাধান হয়ে যায়।
জাফরুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]