জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ হাজার কোটি টাকা। এর ৬৪ শতাংশ পরিচালন এবং বাকি ৩৬ শতাংশ উন্নয়ন ব্যয় হিসেবে রাখা হয়েছে। আকারের দিক থেকে এই বাজেট চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ১২ দশমিক ৩ শতাংশ বড়। মূল্যস্ফীতি, সংশোধিত বাজেটে কাটছাঁট করার প্রবণতা এবং খরচ করতে না পারার অদক্ষতাকে আমলে নিলে এই বাড়তি প্রকৃতপক্ষে আমলযোগ্য হয় না। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ হলেও বাজেটের আকারের দিক থেকে এ দেশের স্থান ১২০টি দেশের মধ্যে ৯৫তম।
বাংলাদেশে একটা প্রবণতা হলো, শিক্ষার সঙ্গে অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের বাজেট জুড়ে দিয়ে উপস্থাপন করা। এতে এর আকার একটু বড় দেখায় বটে, কিন্তু শিক্ষা বাজেটের প্রকৃত চিত্র ধরা দেয় না। একসময় ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, এমনকি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেটও শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে উপস্থাপন করা হতো। এরপর শুরু হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাজেট জুড়ে দেওয়ার পালা।
এবারের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বলা দরকার, প্রযুক্তি বলতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগকে বোঝানো হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ নেমে দাঁড়াল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই দুই খাতে মোট বরাদ্দের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ বলা হলেও শুধু শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে এর থেকে আবার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ছেঁটে ফেলতে গিয়ে পরিচালন ব্যয়টিকে মোটামুটি অক্ষত রেখে উন্নয়ন বাজেটের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ রকম কাণ্ড যে কেবল এবারই ঘটেছে তা নয়, প্রতিবছরই এটি করা হয়।
আপাতদৃষ্টে বাজেটের আকার বড় মনে হলেও প্রকৃত খরচ করা হয় অনেক কম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রকৃত খরচ ছিল উপস্থাপিত বাজেটের ৮৪ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটের সার্বিক আকার বর্তমান অর্থবছরের তুলনায় যতটা বেড়েছে, শিক্ষা বাজেট ততটা বাড়েনি। সার্বিক বাজেটের আকার যেখানে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে, শিক্ষা বাজেট বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
গত দেড় থেকে দুই দশকের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা বাজেটের আকার মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও প্রকৃত খরচের হিসাবে তা ১ দশমিক ৭ শতাংশের ওপরে ওঠে না। শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন তাই কেবল বাধাগ্রস্তই হচ্ছে। বাংলাদেশ শিক্ষায় মোট জাতীয় উৎপাদনের ৬ শতাংশ অথবা বার্ষিক বাজেটের এক–পঞ্চমাংশ বরাদ্দ দিতে বিশ্ব পরিসরে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। উভয়টি এখনো অধরা রয়ে গেছে।
শিক্ষা বাজেটের পুরোটায় রয়েছে গত বছরগুলোয় কী করা হয়েছে এবং কী চলমানে আছে তার বর্ণনা। আগামী অর্থবছরের জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত নতুন কোনো উদ্যোগ বাজেটে প্রস্তাব করা হয়নি। অথচ প্রায় সব শিক্ষার্থীই ব্যবহার করে—এমন বল পয়েন্ট কলমের ওপর ১৫ শতাংশ হারে নতুন করারোপের প্রস্তাব করে কলমের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর উচিত হবে তাঁর এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেওয়া।
এবার আসা যাক বাজেটের টেক্সটের বিস্তারে। মনে রাখা দরকার, এটি করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার পর চতুর্থ বাজেট। অতিমারির সময় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেড় বছর পুরোপুরি বন্ধ ছিল এবং আরও ছয় মাস সেগুলো সম্পূর্ণ খোলা যায়নি।
ইউনেসকোর হিসাবমতে সবচেয়ে বেশি দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে—এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান দশম। এ অবস্থায় করোনাপূর্বকালে যে দেশের শিক্ষার মান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এবং একই রকম অন্য দেশগুলোর তুলনায় সন্তোষজনক ছিল না, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় করোনার কোনো প্রভাব পড়বে না, তা হওয়ার কথা নয়। অথচ বাজেটের শিক্ষাসংক্রান্ত ১১ পৃষ্ঠার অংশে ‘কোভিড-১৯’, ‘করোনা’ বা অতিমারি’–জাতীয় শব্দের কোনো উল্লেখ নেই। নেই প্রান্তিক, অসুবিধাগ্রস্ত, পিছিয়ে পড়া, শিখনক্ষতি হয়েছে বা স্কুল বন্ধের সময় পড়ালেখা করতে না পারার কারণে একই শ্রেণিতে পুনরাবৃত্তি করছে বা ঝরে পড়েছে, এমন শিক্ষার্থীদের কথাও।
শিক্ষা বাজেটের পুরোটায় রয়েছে গত বছরগুলোয় কী করা হয়েছে এবং কী চলমানে আছে তার বর্ণনা। আগামী অর্থবছরের জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত নতুন কোনো উদ্যোগ বাজেটে প্রস্তাব করা হয়নি। অথচ প্রায় সব শিক্ষার্থীই ব্যবহার করে—এমন বল পয়েন্ট কলমের ওপর ১৫ শতাংশ হারে নতুন করারোপের প্রস্তাব করে কলমের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর উচিত হবে তাঁর এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেওয়া।
প্রশ্ন হলো, বাজেটে শিক্ষার্থীকল্যাণমূলক কী থাকতে পারত? করোনাকালে এবং তার পরে করা বেশ কিছু গবেষণা প্রতিবেদন এখন আমাদের হাতে রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির এবং ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (ব্র্যাক আইইডি) পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর পৃথকভাবে গবেষণা পরিচালনা করে করোনাকালে শিখনক্ষতির প্রমাণ পেয়েছে। উভয় গবেষণায়ই শ্রেণিভেদে শিখনক্ষতির তারতম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে।
ব্র্যাক আইইডির গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যেসব মা-বাবার কোনো স্কুলশিক্ষা নেই কিংবা যাঁরা নিজেদের প্রাথমিক শিক্ষাই সমাপ্ত করতে পারেননি, তাঁদের সন্তানদের মধ্যে শিখনক্ষতি সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ছেলে-মেয়ে, গ্রাম-শহরভেদেও শিখনক্ষতির তারতম্য রয়েছে। অভিভাবকদের মতে, ২০২২ সালের শুরুতে প্রায় ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখনঘাটতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষে গিয়েছিল। বিদ্যালয়গুলো ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে এদের জন্য অতিরিক্ত প্রাইভেট টিউটর রাখতে হয়েছিল অথবা তাদের কোচিং সেন্টারে পাঠাতে হয়েছিল। দরিদ্র অভিভাবকেরা দুইটার কোনোটাই করতে পারেননি। যাঁরা পেরেছেন, তারা নিজেরাই পড়া দেখিয়ে দিয়েছেন। বছর শেষে অভিভাবকদের মত ছিল, তখনো দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীর শিখনঘাটতি রয়ে গেছে। এরাই আবার ২০২৩ সালে শিখনঘাটতি নিয়ে স্কুল শুরু করেছে। শিখনঘাটতি পূরণে স্কুলগুলোর দায়িত্বই যে প্রধান এবং এখানে সরকারের যে কিছু একটা করণীয় রয়েছে, তার সামান্যতম নজিরও বাজেটে নেই। স্কুলগুলো যেন উদ্যোগী হয় সে জন্য শিক্ষকদের প্রণোদনা দিয়ে এবং বিদ্যালয় পরিদর্শনে নজরদারি বাড়িয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
ব্র্যাক আইইডির গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে করোনার প্রথম বছরে শিক্ষার্থীদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওপরের শ্রেণিতে তুলে দেওয়া এবং দ্বিতীয় বছরে নমনীয় মূল্যায়ন নীতির কারণে এ সময়ে ঝরে পড়ার হার তেমন উদ্বেগজনক না হলেও পুনরাবৃত্তির হার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। প্রাক্-শৈশবকালের (বয়স ৮ বছর পর্যন্ত) শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি। অন্যদিকে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি ২০২২ থেকে জানা যায়, করোনার প্রথম দুই বছরে প্রাথমিক স্তরে ১৮ হাজার ৪৬৩টি বিদ্যালয় এবং প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী কমে গেছে। এর মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা বেশি।
ব্র্যাক আইইডির গবেষণা জানাচ্ছে, প্রায় সমসংখ্যক শিক্ষার্থী বেড়েছে কওমি, নুরানি ও হাফেজিয়া ধারার মাদ্রাসায়। এ যোগসূত্র আরও তলিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এ ধারার মাদ্রাসাগুলো কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীন নয়। ফলে বাজেটে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য কোনো বরাদ্দও নেই।
শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার নজির পাওয়া যাবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়ও। এবারের বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, এ বছর ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি বই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। আগের বছরের বক্তৃতায় তাঁর এ সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮৭৪টি। এ বছর গত বছরের তুলনায় ৩২ লাখ ৫০ হাজার বই কম বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন বলতে আমাদের দুটিই ছিল—একটি অভিগম্যতার হার বৃদ্ধি এবং আরেকটি এ ক্ষেত্রে লিঙ্গ–সমতা অর্জন। করোনার সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এই অর্জন দুটিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বাজেটে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
দেখা যাচ্ছে, শিখনঘাটতিতে থাকা, পুনরাবৃত্তি করা, ভর্তি না হওয়া এবং মূলধারার প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়া শিক্ষার্থীরাই এ সময়ের সবচেয়ে অসুবিধায় থাকা শিক্ষার্থী। এরা এবারের বাজেট থেকে কিছুই পায়নি। আশা করব, সরকার, অর্থমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা শিক্ষার উন্নয়নকে জাতির সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে দেখবেন এবং গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করবেন।
সমীর রঞ্জন নাথ কর্মসূচিপ্রধান, ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট