‘মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ইজ নাউ ডাইয়িং’ (গণমাধ্যমশিল্প আজ মৃতপ্রায়)—এ বক্তব্য প্রতিধ্বনিসহই শুনলাম সম্প্রতি; গণমাধ্যম, জনসংযোগ ও বিজ্ঞাপন বাজারবিষয়ক এক আলোচনায়।
পতিত হাসিনার শাসনামলে ক্ষমতাসীনদের দালাল গণমাধ্যমের কর্ণধারেরা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতেন, স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজনীয় ‘পলিটিক্যাল স্পেস’ নেই, তাই মিডিয়াশিল্পেরও ক্ষতি হচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যম পাঠক ও দর্শকপ্রিয়তা হারিয়েছে, সেও আর নতুন কথা নয়।
আপনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে মানুষের ঝুঁকে পড়াকে মিডিয়ার অধঃপতনের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করতে পারেন, কিন্তু দেখুন, এ দেশ থেকে পরিচালিত অধিকাংশ মিডিয়া সত্তা বিগত দশকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও খুব বেশি বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি।
প্রধানত সত্য বলার সাহস না দেখানো এবং ফ্যাসিবাদকে সহায়তা ও গণবিরোধী অবস্থান নেওয়ায় বাংলাদেশে পত্রিকা ও টেলিভিশন নিয়ে আস্থার সংকট এবং শিল্পে ধস নামে।
মিডিয়ার সাহায্য ছাড়াই ফ্যাসিবাদী শাসক হাসিনার পতন হয়েছে এবং ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার গণমাধ্যমের কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করছে বলে শুনিনি।
তাহলে জন-আস্থা ফিরে পাওয়া এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারছে না কেন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো?
আত্মসমালোচনা ও জনগণকে জানানোর স্বার্থে, একজন পাঠক হিসেবে এই লেখকের প্রশ্ন: গণমাধ্যম এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে সাংবাদিক-সমাজ বিবেক ও প্রকাশ করার স্বাধীনতা চর্চা করছেন কি ঠিকভাবে?
গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণের পক্ষের কাজ এটি। যেহেতু সাংবাদিকতাও একটি রাজনৈতিক পেশা; তাই জনগণের এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব মিডিয়ার।
অতীতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের চোখরাঙানি, এজেন্সির ফোন, বসের মাথা বিক্রি, বিজ্ঞাপন না পাওয়ার শঙ্কা কিংবা মালিকের হস্তক্ষেপে চাকরি হারানোর মতো চূড়ান্ত বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণে সংবাদকর্মীরা ভয় পেয়েছেন। আইনের অপপ্রয়োগের ভীতি, মাফিয়া শাসন ও গডফাদারদের দৌরাত্ম্য তো ছিলই।
প্রথমে ২০০৭ সালের এক–এগারোর সরকার এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী শাসনে মিডিয়ার স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে সত্য, তবু হাতে গোনা দু–চারটি সংবাদপত্র এবং নগণ্যসংখ্যক সাংবাদিক-লেখক মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বাধীনতাকে লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশের চেষ্টাও করে গেছেন।
অন্যদিকে ভীতির পরিবেশের কারণে হোক আর রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বা ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলে হোক, গণমাধ্যমের বৃহত্তর অংশ আত্মবিবাচন বা সেল্ফ-সেন্সরশিপ অনুসরণ করে দেশের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পেশা ও শিল্পেরও বারোটা বাজিয়েছিল।
এখন আমরা পত্রিকার কাটতির কমতি ও টিভির দর্শক হারানো এবং এর ফলে রাজস্ব কমে যাওয়া নিয়ে হাহাকার করি, তাতে কে সহমর্মিতা দেখাবে!
আমরা কি নিজেদের জিজ্ঞাসা করেছি, যদি পাঠক-দর্শক সমর্থন জোগায়, তাহলে কেন বিজ্ঞাপন ছাড়াই সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন সফলভাবে পরিচালনা করা যাবে না?
এই স্বাধীনতা কোথাও বা কারও কাছে জমা রাখলে, গণমাধ্যমের কর্মীরা তা জনগণকে উপহার দিতে পারেন না প্রয়োজনীয় মুহূর্তে। এখন কিশোর–কিশোরীরাও বোঝে, বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ধ্বংস করা হয়েছিল ভোট ডাকাতি, জাতীয় সম্পদ লুট ও পাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ফ্যাসিবাদী শাসনের অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
জন-আস্থা অর্জন করলে রাজনীতিকেরা পান ক্ষমতা, সাংবাদিকেরা পান পাঠক ও দর্শকের ভালোবাসা। বলার দরকার পড়ে না জন-আস্থা হারালে উভয়ের কী পরিণতি হয়; জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর তাঁদের পালানোটাই বুঝিয়ে দিয়েছে।
ফ্যাসিবাদী জামানা ও এখনকার সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের অবস্থার তুলনা মেলে ১৮৯২ সালে শাহজাদপুরে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গীতিকবিতায়:
‘খাঁচার পাখি বলে, “বনের পাখি ভাই, খাঁচার গান লহো শিখি।”/ বনের পাখি বলে, “না, আমি শিখানো গান নাহি চাই।”/ খাঁচার পাখি বলে, “হায় আমি কেমনে বনগান গাই।”/ বনের পাখি বলে, “আকাশ ঘন নীল কোথাও বাধা নাহি তার।”’
এমনকি খাবারের অভাবে থাকা মুক্ত পাখির কাছে যেমন ‘স্বাধীন মরণ হাজার গুণে ভালো’, স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করা মানুষেরাও সে রকম ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখান।
হাসিনার তৈরি খাঁচা থেকে জীবিত বাংলাদেশিদের মুক্ত করতে পাখির মতো গুলি খেয়ে অকাতরে জীবন দিয়েছে বাংলাদেশের তরুণেরা।
এই স্বাধীনতা কোথাও বা কারও কাছে জমা রাখলে, গণমাধ্যমের কর্মীরা তা জনগণকে উপহার দিতে পারেন না প্রয়োজনীয় মুহূর্তে।
এখন কিশোর–কিশোরীরাও বোঝে, বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ধ্বংস করা হয়েছিল ভোট ডাকাতি, জাতীয় সম্পদ লুট ও পাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ফ্যাসিবাদী শাসনের অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
একটি টেলিভিশনের একজন তথাকথিত মালিক লাইসেন্স পাওয়ার দরখাস্তে লিখেছিলেন, তিনি শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত।
এ–জাতীয় মিডিয়ার নৈতিক অবস্থানের নমুনা ছিল হাসিনার প্রেস কনফারেন্সে তাঁর স্তুতি আওড়ানো তোতা পাখিদের ‘কবিতা পাঠের আসর’।
তাই ইতিমধ্যেই স্বাধীন সাংবাদিকতায় অনভ্যস্ত মিডিয়া আজকের পরিবেশেও পাঠক-দর্শকের নেক নজর কাড়তে পারছে না বলেই তাদের ব্যবসায়িক উন্নতির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
এ দেশে মিডিয়ার বর্তমান দশা অনেকটা ছেড়ে দেওয়া কিন্তু একসময় খাঁচায় বন্দী ছিল—এমন পাখির মতোই।
কবির ভাষায়: ‘দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা—কাতরে কহে, “কাছে আয়!”/ বনের পাখি বলে, “না, কবে খাঁচায় রুধি দিবে দ্বার!”/ খাঁচার পাখি বলে, “হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার।”’
তেলাপোকার মতো টিকে থাকা পুরোনো ধাঁচের মিডিয়া রীতিমতো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, বিশেষ করে গণতন্ত্রমনা পূর্ণবয়সী মানুষ এবং স্বাধীনচেতা তরুণ প্রজন্মের পাঠক-দর্শকের কাছে।
নতুন সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ গণমাধ্যমের নতুন চেহারা বা মুক্ত গণমাধ্যম দেখার অপেক্ষায়।
খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক।