বিশ্লেষণ
আসাদ, নূর হোসেনরা যেভাবে বারবার প্রতারিত হন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আবারও একটি নতুন সম্ভাবনা এবং চির আকাঙ্ক্ষিত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সামনে দেশ। বাংলাদেশ কি আবারও শহীদদের আত্মদানের সঙ্গে প্রতারণা করবে? আসবে কি প্রকৃত জনগণতন্ত্র? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন সৌমিত জয়দ্বীপ
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হলেন ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তারিখটা ছিল ২০ জানুয়ারি। তিনি হয়ে উঠলেন সেই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক। কবি শামসুর রাহমান তাঁর সাড়া জাগানো ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় লিখলেন:
‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’
আসাদের লাশের শক্তি এমনই ছিল যে ইতিহাসের নির্মোহ ও সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের এই শহীদ নেতা। আসাদের মৃত্যু আন্দোলনকে এত তীব্র ও বেগবান করেছিল যে তার শক্তিতে ‘লৌহমানব’ আইয়ুব খানের পতন হয় মাত্র দুই মাস পরই।
এরপর সত্তরের নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট পেয়েও গদিতে বসতে পারেনি। সেই ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়ার সর্বৈব ফল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তারপর এল আমাদের মহাবিজয় ও নতুন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র।
মুজিবের যুগ, দীর্ঘশ্বাসের সময়কাল
এই মহাবিজয়ের মৌতাত আমাদের জাতীয় জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হলো না, বরং সে হয়ে উঠল এক দীর্ঘশ্বাসের কাল। স্বাধীনতার জননায়ক হিসেবে লোকপ্রিয় হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব দ্রুতই ‘শাসক’ হয়ে উঠলেন। আশ্চর্যজনকভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন-আকাঙ্ক্ষা তাঁর হাতেই ভূপাতিত হতে শুরু করল। ফলে তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমে নিম্নমুখী হলো। এরপর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট
তাঁর সপরিবার নিহত হওয়া তাঁকে বানিয়ে তুলল ট্র্যাজিক হিরো।
বাংলাদেশের জন্য ট্র্যাজেডি হলো এই যে যাঁর বক্তৃতা ও বাগ্মিতা গণমানুষকে এনে দিয়েছিল ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ জিঞ্জির থেকে চিরমুক্তির স্বপ্ন, তিনি সেই গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সমীকরণটি আপ্ত করতে পারলেন না উপনিবেশ-উত্তর স্বাধীন রাষ্ট্রে।
১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি, স্বাধীন দেশে রঞ্জিত হলো ঢাকার রাজপথ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে মিছিল করতে গিয়ে শহীদ হলেন ছাত্র ইউনিয়নের মতিউল-কাদের। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে সংঘটিত হলো ছাত্রলীগের ন্যক্কারজনক সাত খুনের ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ারের শিকার হলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সিরাজ সিকদার।
এ ছাড়া সংবিধান কাঁটাছেড়া ও নিত্যনতুন বিধিব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাকশাল প্রবর্তনের ফলস্বরূপ ইতিহাসের ক্রিটিক্যাল বিশ্লেষকদের মত হলো, তাঁর হাতেই সূত্রপাত ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরাচারী রাজনৈতিক বন্দোবস্তের। আহমদ ছফার বিখ্যাত গ্রন্থ যদ্যপি আমার গুরু-তে এই বয়ানের যথার্থতা মেলে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতায় (পৃষ্ঠা ৭৩):
‘...নাইন্টিন সিক্সটি নাইন থেইক্যা সেভেন্টি ওয়ানপর্যন্ত সময়ে শেখ সাহেব যারেই স্পর্শ করছেন, তার মধ্যে আগুন জ্বালাইয়া দিছেন। সেভেন্টি টুতে একবার ইউনিভার্সিটির কাজে তাঁর লগে দেখা করতে গেছিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মানুষের লগে মিশছেন ত আদব লেহাজ আছিল খুব ভালো। অনেক খাতির করলেন। কথায়-কথায় আমি জিগাইলাম, আপনের হাতে ত অখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনের কী করবেন। অপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে। জওহরলাল নেহেরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশন পার্টি গইড়্যা তোল। শেখ সাহেব বললেন, আগামী ইলেকশনে অপজিশন পার্টিগুলা মাক্সিমাম পাঁচটার বেশি সীট পাইব না। আমি একটু আহত হইলাম, কইলাম, আপনে অপজিশনরে একশো সিট ছাইড়্যা দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।’
মুজিব-উত্তর যুগ, বাধার বিন্ধ্যাচল
মুজিব-উত্তর এ কালের প্রাথমিক মেয়াদ ১৫ বছর (১৯৭৫-১৯৯০)। শেখ মুজিবের চিরবিদায়ের পরপরই হত্যা করা হলো আওয়ামী লীগের জাতীয় চার নেতাকে। অঘটনঘটনপটিয়সী পঁচাত্তরের নভেম্বরে আরও বিশাল পটপরিবর্তন ঘটে গেল। রাজনীতির পাশা খেলার রঙ্গমঞ্চে আবিভূর্ত হলো সেনাশাসন। প্রথমে জিয়াউর রহমান, তাঁর রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের পর মসনদে এলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
এ সময় ‘শিশু’ বাংলাদেশ আরও একটু বয়সী হলো ঠিক, তবে ‘টিনএজ’-এ পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তার বুকে রক্তের বন্যা বয়ে গেল৷ মাত্র ২০ বছর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কোনো সময়ই নয়। অথচ পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, এ সময়কালে রীতিমতো তামাশার নরককুণ্ডে পরিণত হয়ে গেছে সার্বভৌম এই রাষ্ট্র। জনতা বনাম ক্ষমতার বাইনারিতে ক্ষমতা হয়েছে নিরঙ্কুশ, আর জনতা হয়েছে ব্রাত্য! কী যে এক বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে উঠেছিল এ রাষ্ট্রব্যবস্থা, তা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে ভালোভাবেই বোঝা যায়।
ফলাফল ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাফর-জয়নাল-দীপালি-কাঞ্চনের লাশ; ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্রদের মিছিলে ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল ট্র্যাক’ (ফরহাদ মজহারের বিখ্যাত কবিতার শিরোনাম) উঠে পিষে ফেলল সেলিম-দেলোয়ারকে। কিন্তু এরশাদ শাহিকে থামানো গেল না। আরও জুলুমবাজ হয়ে উঠল তাঁর শাসিত রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু পতন ঘটাতে না পারলেও, এরশাদের আরশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল একটি লাশ—নূর হোসেন তাঁর নাম৷
শহীদ নূর হোসেন—বুক তাঁর বাংলাদেশের হৃদয়
১৯৮৭ সাল। ছয় মাসব্যাপী সে আন্দোলনের এক পর্যায়ে, ১০ নভেম্বর শহীদ হন ২৪ বছর বয়সী অখ্যাত নূর হোসেন। তাঁর বুকে-পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক/ গনতন্ত্র মুক্তি পাক’ (ভুল বানান অক্ষত রাখা হলো) কথামালা তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর। তাঁর ‘পোস্টারবয়’ জ্যান্তরূপ (বুকেরটির আলোকচিত্রী দীনু আলম, পিঠেরটির পাভেল রহমান) যে কল্লোল তুলেছিল এই বাংলাদেশে, তা চোখ বন্ধ করে ভাবলে চলে যাওয়া যায় আলবার্তো কোর্দার তোলা সেই ব্যারেটা পরিহিত বিখ্যাত ছবিটির কাছে, যার নাম ‘গেরিলা হিরোয়িকো’, মুখশ্রীতে আর্নেস্ত চে গুয়েভারা। কিন্তু যে সম্মান চে পেয়েছেন বিশ্বব্যাপী, বাংলাদেশে অন্তত কি মৃত্যুর পরে নূর হোসেন তা পেয়েছেন?
বরং যে প্রতারণা শহীদ আসাদ কিংবা শহীদ ড. শামসুজ্জোহা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের সঙ্গে করা হয়েছে, নূর হোসেনের সঙ্গেও ঠিক সেটিই করা হয়েছে। বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক গড্ডলে পতিত হয়েছিল, সেই গড্ডলেই রয়ে গেছে—নূর হোসেনের মহিমান্বিত আত্মাহুতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তে পরিবর্তন আনতে পারেনি। অথচ তাঁকে নিয়ে কত শত লেখালেখি হয়েছে, গুণকীর্তন হয়েছে, বীরত্বগাথা রচনা হয়েছে, কিন্তু রাজনীতিকদের কূপমণ্ডূকতায় নূর হোসেনরা বারবার জীবন দিয়েও বদলাতে পারেননি বাংলাদেশকে।
তাঁর বীরত্বগাথার প্রসঙ্গ এলেই চলে আসবেন কবি শামসুর রাহমান। তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধান এই কবি নূর হোসেনকে কোনো দিন দেখেননি। অথচ তাঁকে নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন তিনটি কবিতা, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’; ‘একজন শহীদের মা বলছেন’; এবং ‘আলো-ঝরানো ডানা’। এর মধ্যে ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতাটি সন্দেহাতীত অমরত্ব পেয়ে গেছে, যেটি পরে নামলিপি হয়ে ওঠে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের। সেই কবিতায় শামসুর রাহমান লিখলেন:
‘উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে পিঠে
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো ক’রে দেয়;...’
শামসুর রাহমানের উল্লিখিত এ তিন কবিতা, তৎকালীন সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক মতিউর রহমানের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত পাঁচটি নিবন্ধ-প্রতিবেদন ও শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর অলংকরণ মলাটবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয় শহীদ নূর হোসেন নামক এক নাতিদীর্ঘ গ্রন্থ (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৯০, জ্ঞান প্রকাশনী, ঢাকা; প্রথম প্রথমা সংস্করণ: নভেম্বর ২০১৩)। এই গ্রন্থে নূর হোসেনকে যতটা না, তার চেয়েও বেশি আবিষ্কার করা যায় তাঁর পরিবারকে, বিশেষত তাঁর পিতাকে। নূর হোসেন নিহত হওয়ার মাত্র কয়েক দিন পর লেখক মতিউর রহমানের সঙ্গে ঘটনাচক্রে বেবিট্যাক্সিতে পরিচিত হওয়া নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমানের যে অনালোকিত দিকগুলো উঠে এসেছে, তা যেকোনো মানুষকে বেদনাবিধুর করবে, একই সঙ্গে করবে স্বপ্নালু ও প্রত্যাশাপিপাসু। কী দুর্দান্ত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আত্মমর্যাদাবোধ একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের!
নূর হোসেন নিহত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় মতিউর রহমানকে তাঁর পিতা বলেছিলেন, ‘আমি কোনো সাহায্য চাই না। আমি চাই ২২ দলের মধ্যে ঐক্য থাকুক। এর জন্য আমি সব সময় দোয়া করি। প্রতিটি দলই আমার দল। আমার পার্টি বলে কোনো কথা নেই। ভাগাভাগি নেই৷ আমার ছেলে গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়েছে, অন্য আরও পিতামা-তার ছেলেরাও শহীদ হয়েছে। তারা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়েছে। গণতন্ত্র আসুক এ দেশে। মঙ্গল হোক মানুষের। এটাই আমার কামনা।’ (৩১ জানুয়ারি ১৯৮৮, দৈনিক সংবাদ)
স্বৈরাচার এরশাদের দীর্ঘ প্রায় সাড়ে আট বছরের শাসনের যবনিকাপাত ঘটেছিল সাতাশির চেয়েও কমজোরি এক গণ-আন্দোলনের মুখে, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর, আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী নূর হোসেন শহীদ হওয়ারও তিন বছর পর। এরপর দেশে ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’ এল। কিন্তু মজিবুর রহমানের আশা চূর্ণ করে ২২ দল ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল নির্বাচনী লড়াইয়ের নামে। নতুন যে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা রাজনীতিকদের অবিমৃশ্যতায় তাৎপর্যহীন হয়ে গেল।
তারই প্রতিফলন দেখতে হলো ২০২৪ সালে। নূর হোসেনের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে বসল তাঁরই পার্টি আওয়ামী লীগ। তিনটি জনবিচ্ছিন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থা শেখ হাসিনা কায়েম করেছিলেন, তার চূড়ান্ত মূল্য শুধু তাঁদেরই দিতে হলো না, দিতে হলো বাংলাদেশকেই। এর কী জবাব তাঁরা দেবেন নূর হোসেনের কাছে?
আসাদ, নূর হোসেন থেকে আবু সাঈদ—দূরত্ব কত দূর
যুগে যুগে এ দেশে গণ-আন্দোলনের নায়ক বদলেছে। স্বাধীনতার আগে গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক ছিলেন শহীদ আসাদ। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম (৬ মাস) গণ-আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে ঘটা নব্বইয়ের শিক্ষার্থী গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন পুরান ঢাকার বনগ্রামের নূর হোসেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের ইতিহাসেই অভূতপূর্ব ও সবচেয়ে শক্তিশালী শিক্ষার্থী-গণ-অভ্যুত্থান তথা ‘জুলাই জাগরণের’ প্রতীক রংপুরের আবু সাঈদ।
নিঃসন্দেহে, মৃত্যুর আগে নূর হোসেনের লড়াই আর সাঈদের লড়াই এক ছিল না। নূর হোসেনের দাবিটি ছিল স্পষ্ট ও সুদৃঢ়। তিনি জানতেন, তাঁর চাওয়া স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেশভূষার সম্মিলন—এ কারণেই তাঁর মৃত্যুর ঘটনা সারা দুনিয়াতেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল।
সাঈদ শহীদ হন ১৬ জুলাই। ডানা মেলা পাখির মতো দুই হাত প্রশস্ত করে বুক পেতে ঘাতকের সামনে দাঁড়ানোর তাঁর দুঃসাহসিক মৃত্যুদৃশ্য লাইভ কিংবা ধারণকৃত ভিডিওর মাধ্যমে দেখা গেছে। ইন্টারনেটের যুগে মুহূর্তেই ছড়িয়ে গেছে এ দৃশ্য দুনিয়াব্যাপী। কিন্তু তখনো সাঈদ বা সাঈদদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ছিল না, তখনো তা কোটা সংস্কার বা বড়জোর বৈষম্যবিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ তাঁর মৃত্যুই পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, আন্দোলনকে করে তুলেছিল আরও আগুয়ান, বেগবান ও জনসম্পৃক্ত। সেখান থেকে মাত্র ২০ দিনের মাথায় দুনিয়ার দীর্ঘতম জুলাইয়ের পরিসমাপ্তি এবং স্বৈরতন্ত্রের পতন।
আবারও, আবারও একটি নতুন সম্ভাবনা এবং চির আকাঙ্ক্ষিত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সামনে বাংলাদেশ৷ ‘জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি’র যে প্রসঙ্গ স্বাধীন দেশের নয়া সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিপিবদ্ধ হয়েছিল, তা কেতাবসর্বস্ব রয়ে গেছে গত ৫৩ বছরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট যে সর্বপ্লাবী জনজাগরণ, তার প্রতিও সুবিচার হয়নি। উল্টো বারবার রাজপথ রঞ্জিত রক্তের সঙ্গে চরম অবিচার করা হয়েছে।
এবারের লড়াইয়ে সাঈদের মতো প্রাণ দিয়েছেন আরো হাজারো মানুষ। নূর হোসেন তো আজকের তারিখে পরাভূত বীর। তেতো হলেও সত্য, তিনি জিতে গেলে সাঈদদের মরতে হতো না।
বাংলাদেশ কি আবারও শহীদের আত্মদানের সঙ্গে প্রতারণা করবে? আসবে কি প্রকৃত জনগণতন্ত্র?
●ড. সৌমিত জয়দ্বীপ, সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়