সপ্তাহখানেক আগে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। মূলত প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করে মূলত দেশটাকে সংস্কার করার দায়িত্ব নিয়েছে তারা। এই দায়িত্ব নেওয়ার পর এরই মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদত্যাগ, স্বেচ্ছায় অবসর, বাধ্যতামূলক অবসরসহ নানা অজুহাতে ছেড়ে দেওয়া পদে নতুন সরকার দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে আস্থাভাজনদের কাঁধে। এই পদত্যাগের মিছিলে যোগ দিয়েছে বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় থাকা কর্তাব্যক্তিরা। দশকের পর দশক ধরে দলীয় লেজুড়বৃত্তির লুপে আটকা পড়া এসব পদ-পদবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যেমন করেছে দলীয়করণ, তেমনি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে ছিটকেও পড়েছে।
আনাচকানাচে এসব সংস্কারের সংকল্পে বলীয়ান হওয়া নতুন সরকারের কাছে প্রতিদিনই জমা পড়ছে হাজারও অভিযোগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারের শুরুটা ঠিক কোন দিক থেকে শুরু করতে হবে, তার সিদ্ধান্ত উপদেষ্টা পরিষদকেই নিতে হবে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঢেলে সাজানোর অবারিত সুযোগ তাদের রয়েছে, তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রশাসনিক কাঠামো’র নিয়োগ ব্যবস্থাকে ধরা উচিত। সরকারের প্রশাসনিক বিভিন্ন জায়গায় মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে সরকার গঠন করলেও উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানে আর কোনো ‘মনোনীত চর্চা’ দেখতে আমরা আগ্রহী নই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সত্যি সত্যিই যদি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষাকে এগিয়ে নিতে চায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক নিয়োগ ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রচলিত অধ্যাদেশ বা আইনের মধ্যে শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেটি করতে ব্যর্থ হলে কিংবা রাজনৈতিক সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্তর্বর্তী সরকারও যদি পছন্দের ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে দেয়, তাহলে উচ্চশিক্ষার কোনো পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব না। তাই পদত্যাগের হিড়িক পড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগগুলো সময় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালার আলোকেই হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত দুই ধরনের আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৬১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রচিত ‘প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ আইনের অধীনে বুয়েট, রুয়েট, চুয়েট, কুয়েট যেমন রয়েছে, তেমনি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ আইনের আদলে চলছে। এই অধ্যাদেশের ১১(১) ধারায় উপাচার্য নিয়োগে বলা হয়েছে, আচার্য কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে শর্ত সাপেক্ষে চার বছরের জন্য নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করবেন।
অন্যদিকে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে চলা বাংলাদেশের প্রধান চারটি (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর) বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ১১(১) ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, উপাচার্য নিয়োগে মূলত সিনেট কর্তৃক মনোনীত তিনজনের প্যানেল থেকে নির্ধারিত শর্তে আচার্য একজনকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। তিনি পরবর্তী আরও চার বছরের জন্য পুনর্নিয়োগের জন্য যোগ্য বিবেচিত হতে পারেন।
একই ধারার ২ উপধারায় বলা হচ্ছে, ছুটি, অসুস্থতা, পদত্যাগ বা অন্য কোনো কারণে যদি উপাচার্য পদ সাময়িকভাবে শূন্য থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় আচার্য যদি মনে করেন, তাহলে তিনি উপাচার্যের অফিসের কার্যাদি সম্পাদনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
অর্থাৎ প্রথম ধারায় থাকা সিনেট প্রতিনিধিদের দেওয়া উপাচার্যদের তালিকা থেকে সম্পন্ন রাজনৈতিক পক্ষপাতহীন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া সম্ভবপর হবে, যদি সেই সিনেট প্রতিনিধি রাজনৈতিক শক্তির বাইরে গঠিত হয়। কিন্তু আমরা গত কয়েক দশক যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের দিকে নজর দিই তাহলে দেখা যাবে, সেখানে সিনেট থেকে মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগের সংস্কৃতি যেমন চালু হয়নি, তেমনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচনই হয় না। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সিনেট নির্বাচন ফিরলেও সেখানে দখল করেছে রাজনৈতিক সিল।
সিনেট গঠনে ২০(১) ধারায় বলা হয়েছে, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ ছাড়াও সেখানে সরকার কর্তৃক পাঁচজন কর্মকর্তাকে মনোনীত করা হবে। এ ছাড়া স্পিকার কর্তৃক মনোনীত ৫ জন সংসদ সদস্য, আচার্য কর্তৃক ৫ জন শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেটের ৫ জন, কলেজগুলো থেকে ৫ জন উপাধ্যক্ষ, ১০ জন শিক্ষক, শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটের ২৫ জন প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে নির্বাচিত ৩৫ জন প্রতিনিধি, ছাত্রসংসদের ৫ জন প্রতিনিধি থাকার কথা রয়েছে। তিন বছর মেয়াদি এই সিনেটে আদৌ এসব সদস্য দেখা যায় না।
অকার্যকর থাকা ছাত্রসংসদ থেকে শুরু করে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন যেমন থমকে গেছে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল শিক্ষক প্রতিনিধি সিনেট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দায় সারছে, উপাচার্য নির্বাচনে ভূমিকা রাখছে না।
ফলে দ্বিতীয় ধারায় কৌশলে তাঁরা লাল-নীল-সাদা দলের বলিষ্ঠ শিক্ষক নেতা কিংবা রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ব্যক্তি, যাঁরা ক্ষমতায় আসার পর সীমাহীন দুর্নীতি, নিয়োগ–বাণিজ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়কে কর্মসংস্থান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অনিয়ম-অন্যায়ের অভিযোগ পত্রপত্রিকায় ছাপার পরও তাঁদের কাউকে ফৌজদারি আদালতে যেতে হয়নি। বরং পদোন্নতি হিসেবে তাঁরা পুনর্নিয়োগ পেয়েছেন, রাষ্ট্রদূত হয়েছেন, সরকারের উপদেষ্টাও থেকেছেন।
শুধু উপাচার্য নিয়োগই নয়, আচার্যের হাতে থাকা কোষাধ্যক্ষ নিয়োগও একই ক্যাটাগরিতে নিয়োগ হয়ে আসছে। যদিও অধ্যাদেশের ১৪(১)–এ বলা হচ্ছে, শর্ত সাপেক্ষে আচার্য পূর্ণকালীন সময়ের জন্য বেতনভুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে পারেন। তবে এই কর্মকর্তার পদটি দখল করে বসে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া এ পদটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝেই বণ্টন করতে দেখা গেছে।
সিনেটের উপাচার্য, আচার্যের পছন্দের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের সরলীকরণ থাকলেও তা ভেস্তে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসক কাঠামো শক্তিশালী হতে পারে না। ফলে এসব প্রশাসন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন কিংবা স্থানীয় রাজনীতিবিদদের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে। উচ্চশিক্ষার শিরদাঁড়ায় আঘাত করা এসব সেকেলে ব্যবস্থাপনার কারণে আজও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারেনি।
যদিও ১৯৭৩ অধ্যাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো একধরনের কাগজে–কলমে স্বায়ত্তশাসিত উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু আমরা আদৌ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দেখতে পাইনি। সরকারের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তফাত করার মতো আইন–কানুন থাকলেও মূলত প্রশাসনিক কাঠামো গঠনে ঐকতান পরিলক্ষিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার যখন এসেছে, তখনই তারা মর্জিমতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক নিয়োগ ব্যবস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগেও রাজনৈতিক পরিচয়টাকেই মুখ্য হিসেবে ধরা হয়েছে।
একাডেমিক যোগ্যতাকে গৌণ ধরে এগিয়ে চলা এসব লেজুড়বৃত্তিক প্রশাসনিক কাঠামোর খেসারতে ধুঁকতে বসেছে আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা আইনে স্পষ্টত যেসব নিয়মে প্রশাসনিক নিয়োগ হওয়ার কথা তাকে পাশ কাটিয়ে ৫৩ বছর ধরে পছন্দের কিংবা দলীয় বিবেচনায় উপাচার্যদের আসনগুলো দখল করিয়েছে। নিজেদের সাংগঠনিক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো ক্যাম্পাসগুলোয় দখলদারি বজায় রাখতে সফলও হয়েছে।
এসবের কারণে বিশ্বমঞ্চ থেকে পিছিয়ে পড়া আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ কলুষিত। অথচ আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুসরণ করে যোগ্য ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন করতাম, তাহলে আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে দলদাসের শিকার হতো না।
১৯৭৩ অধ্যাদেশে চলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রশাসনিক কাঠামো গঠনে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবীদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও ১৯৬১ সালের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে তা নেই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের এই দ্বিচারী নিয়মের ঘোরটোপে উচ্চশিক্ষালয় থেকে ‘রাজনৈতিকীকরণ’ থামছে না। আচার্যের হাতে যাওয়া উপাচার্য নিয়োগ চলে যায় দলীকরণে। শত শত যোগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই উপাচার্য বনে যাচ্ছেন, যা একধরনের মনোগামিতা। এ ব্যবস্থার সংশোধন আনতে না পারলে, সেকেলে নিয়মের নিয়োগ ব্যবস্থাপনায় দলদাসের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।
নতুন সরকার যদি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংস্কার চায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি প্রশাসনিক কাঠামোতে দলীয়করণ বন্ধ করতে হবে। উপাচার্য নিয়োগে ১৯৭৩ অধ্যাদেশ অনুসরণ করলে রাজনৈতিক দায়িত্বকরণের সুযোগ যেমন বন্ধ হবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যোগ্য মানুষদের হাতে যাবে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় না হোক, অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় স্বচ্ছ কাঠামো থাকা চাই। সরকার চাইলে উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করতে পারে। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কখনোই রাজনৈতিক পরিচয়কে নিয়োগে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, মূলত একাডেমিশিয়ান, নেতৃত্বে অটুট থাকা ব্যক্তিদের পরিচালনা পরিষদে আনা হয়।
আমাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া রাজনৈতিক টিকিটে উপাচার্য নিয়োগের ওই সব নোংরামি বন্ধ করা। আমরা দেখতে চাই, নতুন সরকার পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে নাকি বুক পেতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তনের স্বপ্নে প্রশাসনিক কাঠামোর নিয়োগ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনবে, রাজনৈতিক মদদপুষ্টদের রুখে দেবে।
সমস্যা থাকবে, সংশোধনও করা যাবে। অধ্যাদেশ পরিবর্তন হোক কিংবা আচার্যের নির্বাহী ক্ষমতাবলে হোক, উচ্চশিক্ষালয়ের এ ঘোড়ারোগটি সারিয়ে তোলার দায়িত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাঁধে থাকল!
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]