কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬৩ সালে সতীর্থদের নিয়ে পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে তোলেন মুহম্মদ খসরু। স্বাধীনতার পর আনোয়ারুল হক খান, ওয়াহিদুল হক প্রমুখের সঙ্গে মিলে সংসদের নতুন নাম করেন বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি। সে আমলে হলিউডের বাইরের বিদেশি সিনেমা জোগাড় করা ছিল খুবই কঠিন। এমন প্রতিকুলতার মাঝেও ফিল্ম সোসাইটির মাধ্যমে মুহম্মদ খসরু বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার নানা ভাষার মানসম্মত চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পেতো তরুণ প্রজন্ম। ১৯৬৮ থেকে তাঁর সম্পাদনায় বের হতে থাকে নির্মল চলচ্চিত্র আন্দোলনের মুখপত্র ‘ধ্রুপদী’। বিভিন্ন সময়ে পরে তাঁর নেতৃত্বেই প্রকাশ হয়
‘চলচ্চিত্রপত্র’, ‘ক্যামেরা যখন রাইফেল’-এর মতো অনিন্দ্যসুন্দর সব সংকলন। সংসদ আন্দোলন নতুন মাত্রা যোগ করে এসব অনুপম প্রকাশনা। এসব কর্মযজ্ঞে এক এক সময় এক এক দল তরুণ যুক্ত হয়েছে, তবে সব সময়ই কেন্দ্রে ছিল মুহম্মদ খসরুর অমানুষিক শ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টা।
একদিকে চলচ্চিত্র নিয়ে পঠন-পাঠন, সুস্থ শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্বাচন; অপরদিকে ঢাকায় মুক্তিপাওয়া ক্ল্যাসিক-চলচ্চিত্র দেখা, পাশাপাশি চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে উৎসাহী ও শিল্পশোভন চলচ্চিত্রে আগ্রহী তরুণদের খুঁজে বের করা—একাই সব দায়িত্ব পালন করতেন মুহম্মদ খসরু।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজেরও অন্যতম উদ্যোক্তা মুহম্মদ খসরু। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আওতায় সোসাইটির অনেক সদস্য বিদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগ লাভ করে। চলচ্চিত্র সংসদসমুহের একক আন্দোলনের ফলেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিল্ম আর্কাইভ। চলচ্চিত্র সংসদের প্রাক্তন সদস্য আবদুল আহাদের সহায়তায় প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’ ছবির প্রিন্টও উদ্ধার করেন তিনি। শুধু সংসদ আন্দোলনেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, খ্যাতিমান নির্মাতাদের সঙ্গে সরাসরি কাজও করেছেন। ১৯৭৫ সালে ‘পালঙ্ক’ ছবিতে ভারতীয় চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদারের সহকারী ছিলেন খসরু।
ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন চলচ্চিত্র বিষয়ক বিশাল এক পাঠাগার। সেখানে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রকাশনা ছাড়াও রয়েছে দুষ্প্রাপ্য বই, ম্যাগাজিন ও নানাবিধ জার্নাল। বইয়ের খোঁজে নিয়মিত ঢুঁ মারতেন ঢাকার নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, আজিজ মার্কেট ও কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের দোকানগুলোতে। সংগ্রহ করতেন দুষ্প্রাপ্য বইপুস্তক, সাময়িকী। চলচ্চিত্রকে বড় পরিসরে চর্চার স্বপ্ন নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফিল্ম স্টাডি সেন্টার। দেশি বিদেশি বোদ্ধাদের নিয়ে ওয়ার্কশপ, সেমিনার করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছেন চলচ্চিত্রের দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তর।
শেষজীবনে সমগ্র জীবনের চলচ্চিত্র প্রজ্ঞা আর স্বপ্ন নিয়ে একটা ছবি বানাতে চেয়েছিলেন মুহম্মদ খসরু। হাসান আজিজুল হকের ‘ফেরা’ অবলম্বনে লেখা চিত্রনাট্য ‘নামহীন গোত্রহীন’ নিয়ে ঘুরেছেন বহুদিন; প্রযোজক পাননি। রাষ্ট্রীয় অনুদানের চেষ্টা করেছেন কয়েক দফা, তাও পাননি। শেষে একটা ক্যামেরা জোগাড় করে নির্মাণের যুদ্ধটা শুরু করতে চেয়েছিলেন, সুহৃদরা চেষ্টাও করেছিল। লাভ হয়নি। শেষপর্যন্ত চিত্রনাট্যেই বন্দী থেকে গেছে ‘নামহীন গোত্রহীন’। তার সেই চিত্রনাট্যকে কে দেবে সেলুলয়েডে মুক্তি? কী হবে তাঁর সংগ্রহের ভবিষ্যৎ?
ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জের মোহনপুরে তার পৈতৃক ভিটা। এক সময় চাকরি সূত্রে হুগলিতে থাকতেন বাবা। সেখানেই ১৯৪৮ সালে মুহম্মদ খসরুর জন্ম। প্রথাবিরুদ্ধ এ মানুষটি জন্মদিন পালনে আগ্রহী ছিলেন না। জন্মতারিখটি তাই গোপনই থেকে যায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে পঞ্চাশের দশকে পুনরায় পৈতৃক ভিটায় ফিরে আসেন। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) নকশা কেন্দ্রে আলোকচিত্রী হিসেবে মুহম্মদ খসরুর কর্মজীবন শুরু। বাঁশি এবং সেতার বাজাতেন। ভালো ছবি আঁকতেন। অবসরের পরে গ্রামের বাড়ি মোহনপুরেই থাকতেন, মাঝে-মধ্যে ঢাকায় আসতেন।
মুহম্মদ খসরুর সঙ্গে শেষ দেখা হয় ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। বারডেম হাসপাতালে। হাতে ক্যানুলা। হাসির আড়ালে ক্লান্তির ছাপ। কথাবার্তার মাঝেই বলছিলেন, ‘আর বাড়ি যাওয়া হবে না।’
অমরত্বের লোভ তাঁকে হাতছানি দেয়নি। খ্যাতি, বিত্তবৈভব, রাষ্ট্রীয় পদক, পদ, কোনো কিছুরই প্রত্যাশা করেননি। তবুও বাংলাদেশে যত দিন চলচ্চিত্রচর্চা হবে, নানা অনুষঙ্গে উচ্চারিত হবে মুহম্মদ খসরুর নাম, থাকবেন বহমান।
মার্জিয়া লিপি লেখক ও গবেষক।