স্মৃতিতে স্যার ফজলে হাসান আবেদ, জীবদ্দশাতেই পেয়েছিল পূর্ণতার স্বাদ

ফজলে হাসান আবেদফাইল ছবি

ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় অক্সফোর্ডে, যদিও তার আগে দুয়েকবার দেখা হয়েছিল। চট্টগ্রামে শেল ওয়েল কোম্পানির নির্বাহী থাকাকালীন পদমর্যাদার কারণে সে বিশেষ এক সামাজিক বলয়ে আবদ্ধ হয়ে ছিল। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেখান থেকে সে বেরিয়েও আসে। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কিছুদিন পর আমাদের আরেক বন্ধু ভিকারুল ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে আবেদের ত্রাণ তৎপরতা সম্পর্কে জানতে পারি। জরুরি সংকট মোকাবিলায় সে সমমনা মানুষদের একত্রিত করার চেষ্টা করছিল, যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। একজন করপোরেট এক্সিকিউটিভ হয়েও নিজের আরাম-আয়েশ ছেড়ে সরাসরি একটি জাতীয় দুর্যোগে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আবেদের কর্মপরিধি আরও বিস্তৃত হয়েছে, তবে তা আমার জানা ছিল না। সারা দেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে সে শেল কোম্পানির চাকরি ছেড়ে লন্ডনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কেন গিয়েছিল তা পরে দেখেছি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে লন্ডনে অসংখ্য গ্রুপ কাজ করছিল। সে সময় লন্ডন ছিল বিদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পরিচালিত সব ধরনের আন্দোলন কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল। তখনকার পরিবেশ ছিল কিছুটা বিক্ষিপ্ত, প্রতিটি দল নিজেদের অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী কাজ করছিল। এক পক্ষ অন্য পক্ষের উদ্দেশ্য নিয়েও আপত্তি তুলতে শুরু করে। এ ধরনের জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে আবেদের সঙ্গে আমার আবারও যোগাযোগ হয়।

যে কোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য আবেদ নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছে। মানুষের প্রশংসা কিংবা বিপুল অর্থবিত্ত অর্জনের মাধ্যমে আত্মতুষ্টির চাইতে নিজের কাজের সফলতা দেখেই সে খুশি হতো। আবেদের মৃত্যু নাড়া দিয়েছে অসংখ্য মানুষকে। সে রেখে গেছে আশা ও উন্নয়নের স্বপ্নবাজ উত্তরাধিকার।

আবেদ তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ম্যারিয়েটাকে নিয়ে অক্সফোর্ডে আমাকে খুঁজে বের করে। তারা বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্থ সহায়তা পাঠাচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে আবেদ দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। একটি হলো জরুরি ত্রাণ সহায়তা, অন্যটি দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন। ১৯৭১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেও দেশ স্বাধীন হওয়ার ব্যাপারে আবেদ আশাবাদী ছিল এবং স্বাধীন দেশে কী ধরনের সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারি, তা নিয়েও সে চিন্তাভাবনা শুরু করে।

দেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়ায় আমাদের আলোচনা হতো অনেকটা অনুমান-নির্ভর। যুদ্ধের কারণে সামাজিক কাঠামোতেও দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা এবং অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। তারপরও অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আবেদের মধ্যে এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প লক্ষ্য করতাম। নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে সে শুধু পরিবর্তনের স্বপ্নই দেখত না, বরং অবদান রাখতে সক্রিয়ভাবে কাজ করত।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আবেদ সিলেটে ফিরে এল। গ্রামীণ বাংলাদেশের উন্নয়নে সে নিজেকে যেভাবে নিয়োজিত করেছিল, তাকে কেবল বৈপ্লবিক এক অভিযাত্রাই বলা চলে, যা ছিল তার আগের করপোরেট জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীত। সামনে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। ভেঙেপড়া অর্থনীতি, বিপর্যস্ত জনজীবন এবং স্বাধীন দেশে একটি নতুন সরকার গঠনের চেষ্টা। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আবেদ তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এক কক্ষবিশিষ্ট স্কুল অথবা কাজের ব্যবস্থা করা, সবক্ষেত্রেই সে সাধারণ একটা নীতি মেনে চলত, আর তা হলো ধারাবাহিক উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই পরিবর্তন। সিলেটে কাজ করতে গিয়েই ব্র্যাকের ভিত গড়ে ওঠে, যা এখন বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও।

আবেদের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত সাহসী ও মৌলিক। সে কেবল পরীক্ষিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করেনি, নতুন নতুন পথও আবিষ্কার করেছে। উদাহরণ হিসেবে ক্ষুদ্রঋণের কথাই বলা যায়। একটি পথিকৃৎ মডেল হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ লাখ লাখ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তারপরও আবেদের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে সফল হয়েছে, তা বলা যাবে না। যেমন তার গভীর নলকূপ কর্মসূচি। যার মূল লক্ষ্য ছিল ভূমিহীন কৃষকদের ক্ষমতায়ন। জমির মালিকদের কাছে সেচের পানি বিক্রি করে আর্থিক ক্ষমতায়নের সুযোগ করে দেওয়া। তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর কারণে সেটা সফল হয়নি। তারপরও আবেদের ঝুঁকি নেওয়া, যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মানসিকতা এবং প্রতিনিয়ত শেখার অদম্য আগ্রহ ছিল।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রতিষ্ঠার সময় তার অকুণ্ঠ সহায়তার কথা স্পষ্টভাবে মনে পড়ছে। ধারণাটি ছিল খুব সাধারণ। পাবলিক ডিসকোর্স এবং নীতি তৈরির জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা। আমার এই উদ্যোগকে যারা সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে প্রথম সারির একজন ফজলে হাসান আবেদ। সে বিনা আপত্তিতে আন্তরিকভাবে সহায়তা করেছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মাধ্যমে জ্ঞান চর্চার প্রসারে সে খুবই আগ্রহী ছিল, যা তার সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও প্রতিফলিত হয়েছে।

আবেদের নেতৃত্বের অন্যতম গুণ হলো, যে কোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। সে বুঝতে পেরেছিল টেকসই উন্নয়নের জন্য দাতা তহবিলের ওপর স্থায়ীভাবে নির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের অর্থায়নে টিকে থাকার মতো উদ্ভাবনী মডেল প্রয়োজন। একই সঙ্গে দাতাদের অগ্রাধিকার পরিবর্তন সম্পর্কেও তার ভালোই ধারণা ছিল। সে জন্য ব্র্যাকের নানা কর্মসূচিকে সতর্কভাবে সাম্প্রতিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে রাখত।

সেই প্রবণতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ‘এক কক্ষবিশিষ্ট স্কুল’-এর প্রবর্তন। আমার আত্মীয়া কানিজ ফাতেমা ওই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভারতের পুনেতে সফলভাবে বাস্তবায়িত একটি মডেল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক দাতা সম্প্রদায়ের কাছে যত দিন না শিক্ষা অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে ওঠে, তত দিন আবেদ ওই কর্মসূচিকে বড় পরিসরে পরিচালনা করেনি। যথাসময়ে সে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের ব্যবস্থা করে এবং এটি ব্র্যাকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজে পরিণত হয়।

আবেদের উদ্যোক্তাসুলভ চিন্তার প্রভাব শুধু ব্র্যাকে নয়, ব্র্যাকের বাইরেও দেখা গেছে। সে তার কর্মকাণ্ডগুলো বৈশ্বিক প্রবণতা এবং দাতাদের আগ্রহের সঙ্গে মিল রেখে পরিচালনার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। ১৯৯০-এর দশকে বিশ্বের মনোযোগ যখন ক্ষুদ্রঋণ থেকে শিক্ষার দিকে স্থানান্তরিত হয়, আবেদ সেই সময়কে কাজে লাগিয়েছিল। তার এক কক্ষের স্কুল প্রকল্প, প্রথমে যেটি পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছিল। তবে পরে সেটিই ব্র্যাকের শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।

সামাজিক উদ্যোক্তার চাইতেও বড় কিছু ছিল আবেদ, ছিল দূরদর্শী নেতা। চাইলেই সে যে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতে পারত। ব্যবসায়িক দক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের কারণে সে সমাজ বদলের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। সামাজিক উদ্যোক্তাদের মধ্যেও সে ছিল পথিকৃৎ। উদ্ভাবনী ও টেকসই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কীভাবে কার্যকর পরিবর্তন আনা সম্ভব, তা আবেদ করে দেখিয়েছে। তার নানা উদ্যোগ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী লাখো মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

যে কোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য আবেদ নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছে। মানুষের প্রশংসা কিংবা বিপুল অর্থবিত্ত অর্জনের মাধ্যমে আত্মতুষ্টির চাইতে নিজের কাজের সফলতা দেখেই সে খুশি হতো। আবেদের মৃত্যু নাড়া দিয়েছে অসংখ্য মানুষকে। সে রেখে গেছে আশা ও উন্নয়নের স্বপ্নবাজ উত্তরাধিকার।

আবেদের সামগ্রিক জীবন পর্যালোচনা করে এই ভেবে বিস্মিত হই যে, সে জীবদ্দশাতেই পেয়েছিল পূর্ণতার স্বাদ। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, রেখে গেছে বিরল ও অসাধারণ সব অর্জন। আবেদ সারা জীবন বৃহত্তর কল্যাণে অসাধারণ কাজ করেছে। অসাধারণ দূরদৃষ্টির পাশাপাশি যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতির যে স্বাক্ষর সে রেখেছে, তা আমাদের জন্য চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রইবে।

  • রেহমান সোবহান অর্থনীতিবিদ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান