স্মৃতি মানুষকে আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু অমীমাংসিত অতীত সততই বেদনা সৃষ্টি করে। একজন মহামানবও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি জীবনের সব কাজ ঠিক করেছেন। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার অনুশীলন এক বিরাট শিক্ষা জীবনের। ভালো কাজের প্রশংসা করা আর খারাপ কাজের নিন্দার করা সমান গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে কারও নেতিবাচক ভূমিকার উল্লেখ না করা, আর কারও অবদান অস্বীকার করা সমান অপরাধ।
সদ্যপ্রয়াত সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে জাসদের রাজনীতি না করেও আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের অক্লান্ত যোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি নির্মাণের অন্যতম প্রধান কারিগর সিরাজুল আলম খানের প্রয়াণে, তাঁকে ঘিরে যে বিতর্ক, তার মধ্যে আমার সত্যদর্শন কিছুটা স্বস্তি জোগাতে পারে।
শেরাটন হোটেলে সিরাজুল আলম খানকে ঘিরে যে সান্ধ্যকালীন আড্ডা হতো, সেখানে আমিও শামিল হতাম। সিরাজুল আলম খানের সান্নিধ্যে গিয়ে আবিষ্কার করেছি এক নির্ভেজাল দেশপ্রেমিকের কল্পজগৎ। কল্পজগৎ, কারণ, আমাদের সময়ের নষ্ট রাজনীতি থেকে সে জগৎ যোজন যোজন মাইল দূরের।
ছাত্রদের মধ্যে সিরাজুল আলম খানকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও মেধাবী হিসেবে গণ্য করতেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই ‘গুরু-শিষ্যের’ বিচ্ছেদ হলো। সিরাজুল আলম খান চেয়েছিলেন একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয় দুজনের কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শেষ কথা ছিল, ‘সিরাজ, আমি কমিউনিস্ট হতে পারব না।’এর পর থেকেই সিরাজুল আলম খান ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নেন। গঠন করেন নতুন দল।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বাইরে আরেকটি শক্তিশালী নতুন দল গঠন বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারত। সংসদের ভেতর ও বাইরে শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্র অচল—বঙ্গবন্ধু এ কথা বুঝতেন কী না, তা আমি জানি না।
আওয়ামী লীগ যদি জাসদকে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় রাজনীতি করার সুযোগ দিত, বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতো। তাহলে মুজিব হত্যা, রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রবেশ এবং পাকিস্তানপন্থী ও মৌলবাদী শক্তি উত্থান ঘটত না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশের পশ্চাৎযাত্রাও ঘটত না। বর্তমান বাংলাদেশের চেয়েও সেই বাংলাদেশের অবস্থান আরও অনেক উঁচুতে থাকত। এই কারণেই একদলীয় শাসন কায়েমে তাজউদ্দীন আহমদের সমর্থন ছিল না।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সিরাজুল আলম খানকে নিন্দা করতে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না যে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খান—একে অপরের প্রতি ভালোবাসা মৃত্যুকাল অবধি অক্ষুণ্ন ছিল। একসময় বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা হয়, তাঁর দলের লোকেরা সিরাজুল আলম খানকে হত্যা করার চেষ্টা করতে পারেন, পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তাই তাঁকে উপদেশ দিলেন দেশের বাইরে চলে যেতে। উপদেশ মেনে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আশ্রয় নিলেন চিত্ত সুতারের বাড়িতে। সেখানে তিনি নিয়মিত প্রাতর্ভ্রমণে বের হতেন। একদিন ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে তিনি রেডিওতে শুনতে পেলেন বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর। বাড়ি ঢুকে কাউকে কিছু না বলে, দরজা বন্ধ করে নিজের কক্ষে গিয়ে খাটে শুয়ে পড়লেন। সকালের খাবারের জন্য ডাকতে গিয়ে গৃহকর্ত্রী জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন চিৎ হয়ে শুয়ে উচ্চস্বরে কাঁদছেন বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের এই মহান বীর। ঘটনা দুটি আমাকে জানিয়েছেন সাখাওয়াৎ হোসেন টুটুল, যিনি সিরাজুল আলম খানের সেক্রেটারি ছিলেন। ঘটনাগুলো স্পষ্ট বলে দেয় একে-অপরের প্রতি ভালোবাসার কথা।
শেরাটন হোটেলের আড্ডায় দেখা তাঁর কিছু মানবীয় গুণ উল্লেখ করি। ভারতীয় উপমহাদেশে নেতাদের মধ্যে একটি গুরুবাদী তথা সামন্তীয় আচরণ চোখে পড়ে, কিন্তু সিরাজুল আলম খানের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য ছিল একেবারে অনুপস্থিত। মাঝেমধ্যে গাদা গাদা বই নিয়ে আসতে দেখেছি তাঁকে। তখন তাঁর সঙ্গে দু-একজন সঙ্গীও থাকতেন কিন্তু কাউকে তাঁর বোঝা বহন করতে দিতেন না কোনো দিন। টেবিলে চা এলে আমি অনেক দিন পট থেকে চা তাঁর জন্য কাপে ঢালতে গেছি। তিনি প্রতিবারই আমাকে বাধা দিয়েছেন এবং এটা করতে চাওয়ার জন্য তিরস্কার করেছেন। আমি একবার আড্ডায় খুব দেরি করে পৌঁছাই। গিয়ে দেখি টেবিলের চারপাশে সার্কল হয়ে বসে সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে দাদার শুনছেন। আমাকে দেখেই দাদা সবাইকে অনুরোধ করলেন চেয়ার টেনে একটু দূরে সরাতে, যাতে আমি আমার চেয়ারটা নিয়ে সার্কলের মধ্যে ঢুকে সবার সঙ্গে পাশাপাশি বসতে পারি। আমার বয়স তখন অন্য সবার চেয়ে প্রায় অর্ধেক, কিন্তু দাদা আমাকে অবহেলা করেননি, সবার সঙ্গে একই সমতলে বসতে দিয়েছেন। এই সূক্ষ্ম মানবিক বোধ আমি সারা জীবনেই খুব কম দেখেছি।
সিরাজুল আলম খান একদিন বললেন, ‘একজন ট্রাফিক পুলিশ প্রতিদিন রোদে বা বৃষ্টিতে ৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এক-দুই মিনিট পরপর হাত বদল করে সিগনাল দেন, এতে তাঁর যে কী কষ্ট হয়, তা কি তোমরা কল্পনা করতে পারো?’ আর একদিন বললেন, ‘তুমি দেখবে, অনেকেই বাম ধারার রাজনীতি করেন, কিন্তু বাড়িতে গৃহপরিচারিকাকে ‘বান্দীর বাচ্চা’ বলে গালি দেন, আমি নিজের কানে শুনেছি।’ গণতন্ত্র বিষয়ে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘গণতন্ত্র হলো, তুমি নিজের মতো কতটা ছাড়তে পারো আর অন্যের মতো কতটা গ্রহণ করতে পারো।’ এসব ঘটনা ও কথা একজন মানবিকবাদী মানুষের সাক্ষ্য দেয়।
বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন দল গঠন করা ছিল একটি ইতিবাচক ঘটনা। কারণ, তখন বিরোধী দল বলতে তেমন কিছু ছিল না (সংসদে মাত্র ৯টি আসন ছিল বিরোধী দলের)। আর চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস ছাড়া যেকোনো সরকার স্বৈরাচারী হতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করার একমাত্র উপায় ছিল শক্তিশালী বিরোধী দল। ‘লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ঠেকাও’—এই মার্কিন নীতির আলোকে অনেকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সিরাজুল আলম খানের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু এটা একটা অন্যায় প্রশ্ন।
সহকর্মীদের নিয়ে ষাটের দশকে সিরাজুল আলম খান নিউক্লিয়াস প্রতিষ্ঠা করেন শুধু স্বাধীনতার লক্ষ্যে এবং এটা বিস্তৃত করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও শ্রমিকদের মধ্যে। বস্তুত আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন তাঁরই কীর্তি। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের নেতাদের চিরকুমার থাকার, এমনকি বিলাসী জীবন যাপন না করার শপথও ছিল। সত্য হলো, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন ছাড়া আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য অন্য কোনো নেতার মধ্যে পুরোপুরি স্বাধীনতার চিন্তা ছিল না। তাঁদের চিন্তা ছিল স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত। দেশকে স্বাধীন করার এমন প্রেষণা যাঁর, তিনি দেশের ক্ষতি সাধন করবেন—এ রকম চিন্তা উদ্ভট। কারণ, সমাজতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে সমাজতন্ত্রের বিপরীতে কাজ করা দেশের ক্ষতিসাধনেরই শামিল। আরও মনে রাখতে হবে, যে আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, স্বাধীনতা-অন্তঃপ্রাণ একজন মানুষ মার্কিনদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন, এমন চিন্তার সম্ভাব্য কারণ বিদ্বেষ, অজ্ঞতা অথবা বিশ্লেষণী ক্ষমতার অভাব।
তবে সিরাজুল আলম খানের অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অবস্থানকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সব মানুষই ভুল করেন, কিন্তু তাঁর ভুলের পরিমাণ আমার বিবেচনায় একটু বেশি। ভুলের একটি নাতিদীর্ঘ বিবরণ দিই। মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি তাজউদ্দিন সরকারের বিরোধিতা করেছেন। যদিও সিরাজুল আলম খান তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। একসময় শেখ মনির সঙ্গে মতদ্বৈততা দেখা দেয় এবং ১৯৭১-এর অক্টোবর থেকে তিনি বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকেন। জাসদ প্রতিষ্ঠা করে নেতৃত্ব দেন আবদুর রব ও মেজর জলিলের হাতে, যাঁরা কোনো নেতৃত্ব গুণের পরিচয় দিতে পারেননি।
ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করার পরিকল্পনা, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করা যে ভুল ছিল, তা কর্নেল তাহেরের ফাঁসির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো। জিয়াউর রহমানই প্রথম সংবিধানে ধর্ম যুক্ত করেন, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেন। অথচ বাঙালিত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সিরাজুল আলম খানের পরম আরাধ্য। যে জিয়াউর রহমান প্রাণরক্ষাকারী তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর কর্মসূচি সমর্থন করা, তাঁর প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং স্বৈরাচারী এরশাদ যিনি রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করে বাংলাদেশের একটি স্থায়ী ক্ষতি সাধন করে দিয়ে গেছেন, তাঁকে সমর্থন ও উপদেশ দান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সিরাজুল আলম খান—দুজনেরই খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল। দারিদ্র্য মুক্ত হবে, এমন একটা দেশ তাঁরা চেয়েছিলেন। ১৯৭১-এ পশ্চিমবঙ্গে শিবদাস ঘোষের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সাক্ষাৎ হয়। শুরু করেন মার্ক্সবাদী সাহিত্য পাঠ। তাঁর উপলব্ধি হয়, সমাজতন্ত্র ছাড়া মুক্তি নেই। তাই স্বাধীনতার পরপরই তিনি একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর এ উপলব্ধি হয় অনেক দেরিতে। সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য হওয়ায় তিনি ওয়েস্টমিনস্টার ধারার পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির বিশ্বাস উবে যেতে অনেক সময় লেগে যায়। ১৯৭৪ সালে বাকশালের মধ্য দিয়ে একটি সমতাবাদী সমাজ নির্মাণের শেষ চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধু।
সিরাজুল আলম খানকে রাজনীতিক হিসেবে দিনশেষে ব্যর্থ বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাই তাঁর সাফল্যের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তৎপরতার জন্য যদিও ম্লান হয়ে গেছে সে সাফল্যের অনেকখানি।
ড. এন এন তরুণ গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]