আমরা কেন গুগল-ফেসবুক বানানোর কথা ভাবতে পারি না

টেলিভিশনের টক শো হোক অথবা চায়ের চুমুকে বন্ধুদের আড্ডা, সবখানেই দেশের আর্থসামাজিক বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। বর্তমান বিশ্ব চলছে আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভর করে। এই দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান খুবই অসন্তোষজনক। একই সময়ে স্বাধীন হয়েও কাতার, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থানে আকাশ-পাতাল পার্থক্যের কারণ কী? আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি, নাকি লোকবলের অভাব? এর কারণ হলো, আমাদের দেশে গবেষণাসংস্কৃতির দুরবস্থা।

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তুলনায় শত বছর পিছিয়ে। কথাটির অর্থ ও যৌক্তিকতা সহজেই অনুমেয়। চলছি আমরা লাখ মাইল দূরের শ্বেতাঙ্গদের পিঠে চোখ রেখে। পশ্চিমা রাষ্ট্রকর্তৃক উদ্ভাবিত প্রযুক্তির প্রচলন আমাদের দেশে শুরু হওয়ার আগেই সেই দেশে নতুন জেনারেশন উদ্ভাবন ও প্রচলন শুরু হয়ে যায়। আর আমরা ব্যতিব্যস্ত রয়েছি কুড়িয়ে পাওয়া প্রযুক্তির উল্লাসে।

প্রযুক্তির গুরুত্ব বোঝাতে অধিক শব্দের প্রয়োগ অপ্রয়োজনীয়। উৎপাদনের ক্ষেত্রে যত অত্যাধুনিক ও কার্যকরী যন্ত্রের ব্যবহার করা যাবে, উৎপাদন ও আয় ততই বাড়বে। একইভাবে উন্নত হবে দেশের অবকাঠামো, চিকিৎসাব্যবস্থা, সামরিক প্রতিরক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থাসহ প্রতিটি ক্ষেত্র। প্রশ্ন জাগে, এই অত্যাধুনিক যন্ত্র-পদ্ধতি, তথা প্রযুক্তি আমরা কোথা থেকে সংগ্রহ করছি এবং কোথা থেকে সংগ্রহ করা উচিত! আমাদের মুখাপেক্ষী হতে হয় আমেরিকা, চীন, জাপান, জার্মানি, ভারত ও রাশিয়ার মতো দেশের আবিষ্কারক ও গবেষকদের দিকে। ভিন্ন জাতির উদ্ভাবিত পদ্ধতি আমাদের দেশে ক্রয় ও আমদানি করা হয় চড়া দামে, যার প্রভাব পড়ে সরাসরি সাধারণ জনগণের ওপর। ফলে সরকারের জনকল্যাণের মূল লক্ষ্যটিই ব্যাহত হয়। এভাবে দেশের উন্নয়নের কার্যক্রম জনগণের জন্য কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেটা একটি বড় আলোচনার বিষয়। কারণ, ওই প্রযুক্তি নিজ দেশে আবিষ্কার ও বাজারজাত করা সম্ভব হলে সাধারণ জনগণ তুলনামূলক কম খরচে পণ্য ব্যবহার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক, পরিবহন খরচসহ নানা ধরনের অতিরিক্ত ব্যয় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানের যে বিশাল বিপ্লব ঘটছে, তাতে কোনো দেশ ইচ্ছা করুক বা না করুক, আধুনিকতার ছোঁয়া তার লাগবেই। দেশের উন্নতির অধিকাংশই সময়ের স্রোতে ভেসে আসা। তবে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় মজবুত অবস্থান তৈরি করতে স্বীয়, স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু পদ্ধতির প্রয়োজন রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনে রাষ্ট্রের ভূমিকা কতটুকু আর কতটুকু নদীর স্রোতে ভেসে আসা, এটা ঝালিয়ে দেখাও প্রয়োজন।

মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম। নেটওয়ার্কের গতি আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, এটি শুধু ক্ষুদ্র একটি উদাহরণমাত্র। মূল বিষয়বস্তু হলো, এই মোবাইল নেটওয়ার্কে দেশের কোম্পানি ও দেশের রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকা কতখানি। এটিই একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করি। একমাত্র টেলিটক বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন, যার গ্রাহকসন্তুষ্টি নির্ণয়ের জন্য বিশেষ কোনো জরিপ করার প্রয়োজন নেই।

মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম। নেটওয়ার্কের গতি আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, এটি শুধু ক্ষুদ্র একটি উদাহরণমাত্র। মূল বিষয়বস্তু হলো, এই মোবাইল নেটওয়ার্কে দেশের কোম্পানি ও দেশের রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকা কতখানি। এটিই একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করি। একমাত্র টেলিটক বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন, যার গ্রাহকসন্তুষ্টি নির্ণয়ের জন্য বিশেষ কোনো জরিপ করার প্রয়োজন নেই। এর কাভারেজ ও গতি সব গ্রাহকের জন্য পীড়াদায়ক। অন্যদিকে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফার ঝুলি পূর্ণ করে চলেছে। এবার যদি কম্পিউটারের বিষয়ে আলোকপাত করি, তাহলে আমাদের ভাগটা প্রায় খালি। কম্পিউটার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অপারেটিং সিস্টেম আবিষ্কার আমাদের জন্য কল্পনা। কারণ, আমাদের তৈরি বিশ্ব মানের অ্যাপ্লিকেশনের নজিরই শূন্যের কোটায়। আমরা গুগল, উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া ও ফেসবুক দেখে শুধু বিস্মিত হই, এমন কিছু তৈরি করা আমরা ভাবতেই পারি না। কারণ, এখানে গবেষণাসংস্কৃতিচর্চার অভাব। দেশের কর্ণধারেরা এ নিয়ে মিছেমিছি স্বপ্ন দেখান আমাদের, কাজের কাজ কিছুই করেন না।

কৃষির ওপর নির্ভর করে দেশ চললেও, দেশের কৃষি চলে বিদেশি অবদানে। বর্তমানে দেশের মোট কৃষিজ যন্ত্রপাতির ৭৫-৮০ শতাংশ আমদানি করা। এসব যন্ত্রের আমদানি, পরিবহনসহ অতিরিক্ত ব্যয়গুলো কৃষকের কাঁধে এসেই ভর করে। উল্লেখ্য, উন্নত বিশ্বে জমি চাষ, পরিচর্যা, কাটা, ভানাসহ সার্বিক কাজে যেসব আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই সে বিষয়ে অবগত নন। সুতরাং, তারা আমাদের থেকে এগিয়ে থাকবে, এটিই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশে একের পর এক গজিয়ে ওঠা ৫৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন শিক্ষক আবিষ্কারক, অথবা কতজন বিশ্ব মানের গবেষণা কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত? এগুলো বিবেচনা করতে আলোচনায় আনা প্রয়োজন শিক্ষক নিয়োগ-বাণিজ্য ও অনিয়মকে। অসুস্থ শিক্ষক-রাজনীতি, নির্বাচনের জাঁতাকলে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোর পাঠব্যবস্থা দেয়ালে পিঠ ঠেকার অবস্থায়। নামমাত্র তাত্ত্বিক পড়াশোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ অধিকাংশই। দেশের অনার্স লেভেলের ব্যবহারিক ক্লাসই যেখানে অস্তিত্ব-সংকটে ভুগছে, সেখানে গবেষণা ও আবিষ্কার আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কী! ঘরে বসে নেটে সার্চ করে বা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মতামতের পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তৈরি কাগজকে গবেষণাপত্র বলা খুবই বেমানান। অন্তত বর্তমান সময়ে এসব কাজকে ছেলেখেলা বলাই বাহুল্য।

আমাদের আবিষ্কার ও গবেষণার ঝুলি যে একেবারেই শূন্য, এমনটা নয়। তবে সেগুলোর মূল্যায়নে যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত। সরকারিভাবে গবেষণার দুরবস্থা প্রকট। বেসরকারিভাবে বহু আবিষ্কারক নিজ মেধার উপযুক্ত ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছেন। তবে দুঃখের বিষয়, আমরা তাঁদের সঠিক সম্মান করতে অক্ষম। ফলে নতুনেরাও গবেষণার কাজে আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। প্রচলিত একটি কথা আছে, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান ২০১৭ সালে পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ উদ্ভাবন করেন। প্রতিনিয়ত পৃথিবী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। রাসায়নিক পদার্থের বিরূপ প্রভাব সামাল দিতে ঝুঁকতে হচ্ছে প্রাকৃতিক পণ্যের ব্যবহারে। পরিবেশে পলিথিনের বিপর্যয়কর প্রভাবের কথা বিবেচনা করলে ওই ব্যাগ একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, যার সঠিক মূল্যায়ন করতে আমরা ব্যর্থ। এবার মোবারক আহমদ খান ও ফারহানা সুলতানা সম্মিলিতভাবে পাটের সেলুলোজভিত্তিক স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড উদ্ভাবন করেছেন। এই অসাধারণ উদ্ভাবনও মাঠে মারা না যায়, এটাই প্রত্যাশা।

মেধার উৎকৃষ্ট ফলন ও শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। অবকাঠামো উন্নয়নের আগে প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন। গবেষণা খাতের এই বিরূপ অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এই খাতে একটি বৃহৎ অঙ্কের বাজেটের অনুমোদন ও পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে নতুনত্ব আনতে হবে গবেষণাপদ্ধতিতে। তাহলে আমাদের দেশের গবেষণাসংস্কৃতির দৈন্য কাটানো সম্ভব হবে এবং মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব হবে।

আসিফ হোসেন শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া