আমাদের বাংলাদেশের পরিবেশ কয়েক বছর ধরে রয়েছে চরম বিপর্যয়ের মুখে। পরিবেশের বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী নানা ধরনের উপাদানের কারণে বর্তমানে আমাদের পরিবেশ এখন প্রায় ধ্বংসের মুখে। দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে, ততই প্রভাব পরছে আমাদের প্রকৃতির ওপর। নানামুখী চাপে আজ পরিবেশ বিপর্যস্ত। তার মধ্যে রয়েছে আবার আমাদের হাতে পরিবেশ ধ্বংসকারী নানান প্রকারের বস্তু, যেমন প্লাস্টিক, পলিথিন, পানি শোষণকারী বিদেশি জাতের পরিবেশ ধ্বংসকারী বিভিন্ন রকম গাছ, কার্বন নিঃসরণকারী নানামুখী প্রকল্প, গাড়ির কালো ধোঁয়াসহ আরও বিভিন্ন উপাদান।
আর এ সবকিছুর মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখছে অপচনশীল বস্তু, যেমন প্লাস্টিকের বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও পলিথিন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই প্লাস্টিক ও পলিথিন যতভাবেই প্রক্রিয়া করা হোক না কেন, তা সহজে পচন হয় না। এই বস্তু যদি মাটির নিচে পড়ে তাহলে ওখানে পচতে সময় লাগবে সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ বছর। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে মাটির নিচে গেলেও ধ্বংস করছে এই পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য মাটির স্বাভাবিক স্তরকে।
পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়ে এখন আমাদের পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্য ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের নাম উঠে আসছে। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ঝুঁকির বিষয়গুলোর পাশাপাশি জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের মতো বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে। পলিথিন বর্জ্যের ক্ষতিকর দিকগুলো আলোচিত হচ্ছে নানাভাবে।
ঢাকাসহ সারা দেশে পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনতে আইনের পরিবর্তনের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তার কোনো সুফল দেখা যায়নি। আইন থাকলেও আইনের সঠিক বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় তা কোনো কাজে আসছে না।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতার চিত্র উঠে এসেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০২ সালে শর্ত সাপেক্ষে সব রকমের পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, মজুত ও বিতরণ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। কাগজে-কলমে আইন থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ না থাকলে যা হয়, তেমনটিই হয়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহারবিধির আইনের ক্ষেত্রে।
পলিথিন যে নিষিদ্ধ, এটা যেন সবাই ভুলে গেছে। উৎপাদক, আমদানিকারক, বিক্রেতা-ক্রেতা কেউই পলিথিনের শপিং ব্যাগ-সংক্রান্ত আইন মানছেন না। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষেরও যেন এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকায়ই প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। পলিথিন ছাড়া অন্য প্লাস্টিক বর্জ্যও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রয়েছে চরম দুর্বলতা।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে জাতীয় মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকলেও ২০২০ সালে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ টনের মতো, যা মোট ব্যবহারের প্রায় ২০ ভাগ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, এ সময়ে উৎপাদিত ১৪ লাখ ৯ হাজার টন প্লাস্টিক পণ্যের অর্ধেকের বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেজিং খাতে। বিশেষত পলিথিনের ভয়ংকর আগ্রাসন আমাদের সামগ্রিক পরিবেশ ও বাস্তু ব্যবস্থাপনাকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ঢাকা শহর ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের অপরিমিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আমরা যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাব ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি, ড্রেন, নালা, খাল ও পতিত জলাশয় প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিনে বদ্ধ হয়ে আছে।
আর সেখানে পানিসহ সবকিছুই দূষিত হচ্ছে। আর সেই বদ্ধ জলাশয়ের দূষিত পানিতে জন্ম নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগবাহিত এডিস মশাসহ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো নানা ধরনের রোগবালাই। যার কারণে পরিবেশ এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আর তাই আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে আমাদের পতিত হতে হবে মহাকালের মহাবিপর্যয়ে।
আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিভিন্ন পলিথিন ও প্লাস্টিক কারখানা ভাবনাহীন ভাবে উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। যেখানে আইনের কোনো প্রয়োগ দেখতেই পাওয়া যায় না। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আইন করে নিষিদ্ধ করলেও যার প্রয়োগ বর্তমানে চোখেই পড়ে না। শুরুতে আইনের কঠোর প্রয়োগ হয়েছিল। যে কারণে পলিথিনের শপিং ব্যাগ ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শৈথিল্যের কারণে পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে। কারখানাগুলো দিব্যি পলিথিন উৎপাদন করছে, বাজারজাত করছে। মানুষের হাতে হাতে পলিথিনের শপিং ব্যাগ। অথচ এর কিছুই কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ছে না।
পলিথিনের বিকল্প হয়ে উঠেছিল যে কাগজ বা পাটের ব্যাগ, তা বিলুপ্তির পথে। সরকার পাটের কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। যার কারণে প্লাস্টিকের কারখানাগুলো রমরমা ব্যবসা করছে। আমরা যত যা কিছুই বলি না কেন, এই ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়কারী পণ্য যদি বন্ধ করতে না পারি, তাহলে যেমন আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব না, তেমনি পারব না আগামী প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর সুশীতল সবুজ পৃথিবী রেখে যেতে।
তাই এখনই প্রয়োজন নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করা। এর উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যবহারকারী পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ পলিথিন কারখানা সিলগালা করতে হবে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কাগজ বা পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা গেলে হয়তো পাটকলগুলোকে রক্ষা করা যাবে। পলিথিন ও প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদনের যথার্থতা নিরূপণ ও নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কঠোর হতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে এর পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিংসহ সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই হয়তো আমরা একটা নিরাপদ বাসস্থান রেখে যেতে পারব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
আলকামা সিকদার
গণমাধ্যমকর্মী